(১)
সর্ব্ব কৰ্ম্ম সমাপিয়া,
শ্রান্ত দেহ, ক্লান্ত হিয়া,
অন্তিম শয্যায় শুয়ে নিশি;
শশধর ক্ষীণলেখা,
মুমূর্ষুর হাসিরেখা,
পাণ্ডুবর্ণ ওষ্ঠাধরে রহিয়াছে মিশি।
ডাকি’ দিক-বন্ধুগণে,
সকরুণ সম্ভাষণে,
বিদায় চাহিয়া খিন্ন মনে;
ছিন্ন করি’ তারাহার,
প্রীতি-চিহ্ন উপহার
শ্রীহীন করিয়া তনু, দিলা জনে জনে।
মৃত্যুর ঘুমের কোলে,
নেত্র ধীরে এল ঢ’লে,
হেরি শেষ, আনন ধরার;
বিভুনাম সুধাধার,
ঢালিল শ্রবণে তার,
বিহঙ্গ, গায়ক প্রিয় প্রকৃতি-মাতার।
ঢাকি’ তনু শ্যাম বাসে,
শোকাশ্রু শিশিরে ভাসে,
ধরণী,- নিশার আদরিণী;
কবরী খুলিয়া গিয়া,
চুল পড়ে এলাইয়া;
ফুল খসে’ খসে’ পড়ে চিকুর-শোভিনী।
(২)
পূরব-দিগন্ত-কোলে
পুরী এক মনোরমা;
নিবসে রূপসী তথা
ঊষা নামে সুরাঙ্গনা।
কনক-জলদ-বাসে
পূত তনু আবরিয়া,
মাণিকের টিপ পরি,
আছে যথা ঘুমাইয়া;
ঘুমন্ত শ্রবণ-যুগে
পশিল সহসা তার,
শোকাতুরা ধরণীর
মৰ্ম্মভেদী হাহাকার।
ভেঙে গেল ঘুম; ত্রস্তে
রমণী উঠিলা জাগি’;
চাহিলা চৌদিকে, মেলি’
করুণ আয়ত আঁখি।
খুলি দিক-পথ-দ্বার
ত্বরায় আসিলা নামি,
শোক-শয্যা ‘পরে যথা
শুইয়া ধরণী রাণী।
‘প্রভাত-সমীর’ নামে
সাথে শিশু সুকুমার;
নেহালে চৌদিক, ধরি
সোণার আঁচল মা’র।
খোলা ভোলা মনে তার
হরষ উছলে সদা;
প্রাণ তার চায়, ফিরি’
খেলাইতে যথা তথা;
অমৃতময়ের গৃহে
শিশু সে আনন্দ-খনি;
জড়েও জীবন লভে-
ছুঁয়ে সে পরশ-মণি।
আকুলি, ধরার হেরি,
সিক্ত মুখ অশ্রুজলে;
ব্লুটায়ে পড়িয়া বুকে,
জড়ায়ে ধরিল গলে।
চুম্বন করিয়া মুখে,
সৰ্ব্বাঙ্গ আলোড়ি তার,
পুলক সঞ্চারি’ দিল
হৃদয়ের চারিধার!
আপনি আসিয়া ঊষা
বসিলা শিয়র-তলে;
অযত্ন-লুন্ঠিত তনু
তুলিয়া লইলা কোলে।
রাখিয়া শ্রবণে তার
শান্তি-মাখা মুখখানি;
সুধীরে অমৃত ভাষে
কহিলা সান্ত্বনা বাণী।
সুখের স্বপন হেন
সে বাণী মধুরতম,
ধরার হৃদয়ে পশি
সৃজিল আনন্দ ঘন।
মেলিয়া কমল-আঁখি
চাহিল সম্মুখে ফিরে;
খোলা পথে দিবাকর
নিকটে দাঁড়াল ধীরে।
অঞ্জলি ভরিয়া নিজ,
সে শ্যাম চরণযুগে,
কিরণ-কুসুমরাশি
সঁপিল সস্মিত মুখে।
সে স্বর্গ-কুসুম-স্পর্শে
ধরার শ্যামল কায়,
উঠিল উজ্জ্বল হ’য়ে
পরিপূর্ণ মহিমায়!
ক্রন্দন-কম্পিত ওষ্ঠে
বিকশি উঠিল হাসি;
শোভিল মুকুতা সম
সুরঞ্জিত অশ্রুরাশি!
নিরাশার, সাথে আশা, সান্ত্বনা, শোকের সাথে,
চিরকাল,- চিরকাল, বাঁধা সমসূত্রপাতে।
১৩০৩ সাল।