স্বর্ণবরণ চন্দ্রকিরণ সিন্ধুর নীল অঙ্গে,
নিন্দিত নীলকান্ত-দ্যুতি প্রতিবিম্বিত তরঙ্গে।
স্থির গভীর নির্ব্বাক্ নীর, নিদ্রায় যেন মগ্ন;
পুষ্পিত শ্যাম প্রান্তর তট সুখ-শয্যায় লগ্ন।
চপল চটুল ঊর্ম্মি-শিশুরা কৌতুক-ক্রীড়া-ক্লান্ত,
নিদ্রিত মা’র বিশাল বক্ষে বন্ধনে স্নেহাক্রান্ত।
স্তব্ধ, মৌন, নিশীথ-রাত্রি, শীতল, মন্দ বায়,
জ্যোৎস্না-ধৌত সুনীল অভ্রে চন্দ্র তারকা ভায়।
শান্ত মহান্ সিন্ধুর তীরে উপলখণ্ড-আসনে,
শোভনমূর্ত্তি, গৌরকান্তি, মণ্ডিত সিত বসনে-
নবীন যুবক, মগন ধ্যানে; কুঞ্চিত কেশজাল
লুঠিছে, আবরি’ বয়ান, চক্ষু, পৃষ্ঠ, বক্ষঃ, ভাল।
সম্মুখে তার, চিত্র লেখনী সজ্জিত থরে থরে;
মৌনিতা ভেদ করিয়া সহসা, মর্মপীড়িত স্বরে-
কহিলা শিল্পী,- “মিছা কল্পনা জল্পনা যত মোর;
“গণ্ডীর মাঝে অনন্তে চাহি বান্ধিতে দিয়া ডোর!
“উন্মাদ হেন যদি এ প্রয়াস, ক্ষম দেবি! অপরাধ;
“অর্পিনু আজি পদতলে তব যত কিছু আশা সাধ।
“যুগ-যুগান্ত-সাধনা-লব্ধ ব্যর্থ রত্নরাজি,
“লহ, লহ ফিরে;- অঞ্জলি ভরি’ আসিয়াছি দিতে আজি।
“লহ, ফিরে লহ, তোমারি দত্ত যশের পুষ্পমালা;
“লহ, নিষ্ফল তুচ্ছ জীবন, অভিশাপ-বিষে ঢাল!
“তোমারেই যদি, ইষ্টদেবতা! সাধনার ফল মম,
“নাহি পেলু আজো;- বিশ্ব নিখিলে কিবা তবে প্রয়োজন?
“আজিও তোমার সৌন্দর্য্যরাশি না পারিমু ধরিবারে;
“পারি না রহিতে চির-অতৃপ্ত বহিয়া হৃদয়-ভারে।”-
অশ্রুসলিলে আপ্লুত আঁখি, রুদ্ধ কণ্ঠস্বর;-
মার্জ্জিত করি’ বসনে নেত্র, চাহিলা তাহার পর-
বারেক শূন্যে, অরণ্য পুনঃ, বারেক সিন্ধুপানে,
চঞ্চল নেত্রে, ব্যাকুল প্রাণে যেন কার সন্ধানে।
তার পর ধীরে সিন্ধুর নীরে চিত্রিত পটগুলি,
একে একে সব লেখনীযন্ত্র, বিবিধ বর্ণ, তুলি,
করি নিক্ষেপ, ত্যজিয়া আসন উঠিলা চিত্রকর;
নত করি আঁখি, মুহূর্ত্ততরে দাঁড়াইলা স্থিরতর;
তার পর বেগে পলক ফেলিতে, বিস্তারি’ বাহু দুটী,
ঝাঁপ দিলা জলে;- মাতৃবক্ষে শিশু যথা যায় ছুটি’।
(২)
সহসা জ্যোৎস্না হইল মলিন, চন্দ্র তারকা ডুবিল!
লক্ষ সূর্যরশ্মি-প্রভা সিন্ধু ভেদিয়া উঠিল!
মনোমোহকর সৌরভে দিক্ দিগন্ত পরিব্যাপিল!
বৃন্দ বৃন্দ মুরলী রবাব সারঙ্গ বীণা বাজিল!
জ্যোতির মাঝে স্বর্ণকমল অরণ্য উদ্ভাসিল!
কমল-কাননে জ্যোতিৰ্ম্ময়ী কমলে-কামিনী হাসিল!
জ্যোতিৰ্ম্ময় পদযুগ তটে অচেত চিত্রকর;
সুরাঙ্গনারা যন্ত্রের সাথে মিলায়ে মধুর স্বর,-
মূর্চ্ছা-আতুর হিয়ে দিল ঢালি অমিয়া সঞ্জীবন;
ভাঙ্গিল মোহ; ধীরে আঁখি যুবা করিলা উন্মীলন।
(সুরাঙ্গনাদের গীত।)
জাগো ওগো জাগো সখা!
চাহ মীলিত আঁখি।
যুগান্ত তপ জীবনান্ত পণ,
হের,- সফল তব আজি।
বিষাদ শেষ ত্যজিয়া এবে
উঠ গো অভিমানী!
দুর্লভতম শান্তি-আসন
হের,- মুক্ত তোমার লাগি।
বিস্ময়ে যুবা চাহি’ চৌদিকে, ঘুরিয়া উঠিল শির;
আননে মধুর হাস্য ফুটিল, নয়নে বহিল নীর।
আবেগে বক্ষে চাপিয়া চরণ কহিল আকুল স্বরে,-
“দয়া কি হইল ভক্ত সেবকে দেবি! এতদিন পরে?
“কত না করেছি কঠোর সাধনা তব দর্শন তরে;
“অন্তিম কালে পূরাতে বাসনা, আসিলে কি দয়া করে?
সাদরে স্নেহে ধরিয়া হস্ত তুলিয়া লইল। কোলে;
মুছায়ে অশ্রু, চুম্বিয়া মুখ, মধুর স্নেহ-বোলে
কহিলা দেবতা, “বৎস! তোমার সাজে বটে অভিমান;
“ভক্তের কাছে নত মস্তক, ভক্তেরি ভগবান।
“যতদিন তবু বন্ধন সব ছিন্ন নাহিক হয়,
“যতদিন তবু যশের লিপ্সা হৃদয়ে তাহার রয়,
“ততদিন তারে নাহি দিই ধরা, দূরে দূরে তার রই;
“সকল স্বার্থ তেয়াগে যখনি, তখনি তাহার হই।
“আজিকে তোমার মুক্ত বাঁধন, পাতিয়াছি আজি কোল!
“যুগান্ত তপে কঠোর দুঃখ আজিকে বৎস, ভোল!
“চির-উজ্জ্বল বিজয়ী মাল্য এই নে পুরস্কার!
“ঘুচে অশান্তি সর্বব, এই প্রভাবে পুষ্পহার!
“পরি’ এ মাল্য কণ্ঠে, বৎস! ফিরে যা রে! আরবার;
“এখনো সময় হয়নি পূর্ণ, ধরা হ’তে আসিবার।
এই নে আরেক হিরণ্য-তুলি মন্ত্রাভিষেক করা;
“মনে কল্পনা করিবি যা যবে তখনি দিবে সে ধরা।
“তোমার চিত্র, করিবে সৃষ্ট নূতন স্বর্গলোক!
“দেখি সে দৃশ্য, মুগ্ধ মানব ভুলিবে দুঃখ শোক!
১৩০৩ । ১১ই বৈশাখ।