আমার পরম স্নেহময় ভক্তিভাজন
পিতৃদেবতার চরণে
তাঁহার ত্রয়োপঞ্চাশৎ বাৎসরিক
জন্মতিথি দিবসে
উৎসর্গীকৃত হইল।
এ নহে সে প্রতিধ্বনি স্ফুরিত প্রথম
শুভ্র, স্বচ্ছ হৃদয়ের ক্ষুদ্র বালিকার;
কল্পনা-জগত-মাঝে রহিয়া যখন
হেরিত সে সারা বিশ্ব তারি আপনার।
ভাবিত সে- (অসম সাহস একি হায়!)
সে ঘুচাবে জগতের সর্ব্ব দুঃখ, শোক;
দুটী তারি অতি ক্ষুদ্র কর তাড়নায়
সে মুছাবে আছে যত অশ্রুভরা চোখ!
ভাবিত সে- (পাগলের খেয়াল কেবল,)
প্রেমে হবে একাকার নিখিল ভুবন।
হাসি আসে আর চোখে ভরে আসে জল,
মনে পড়ে ববে সেই বাল্যের স্বপন।
সে দিন গিয়াছে চলে;- কার নাহি যায়?
ফুলগুলি কে যেন লয়েছে সব তুলি,
চারি ধারে বিছায়ে রাখিয়া গেছে হায়,
তীব্র, তীক্ষ্ণ শোণিতলোলুপ কাঁটাগুলি।
সে ছিল স্বপ্নের কাল, যতই উদার
যতই মধুর ভাব রহুক না তায়।
সত্য এবে মেলিয়াছে বাহুপাশ তার,
তারে ফিরাবার হায় কি আছে উপায়?
একদিন, জীবনের সেই একদিন-
ও চরণ প্রথম সে পূজেছিনু পিতা,
দিয়া স্বপ্ন-পুষ্প মম প্রল্ফ ট নবীন
বালিকা সে হৃদয়ের প্রথম কবিতা।
আজিকে এসেছি পুনঃ; কি এসেছি নিয়ে
শুধাইবে কি গো পিতা? এসেছি কি হায়,
তোমায়ে। বিধিতে মোর কাঁটাগুলি দিয়ে?
হৃদয় নিজেরে তাই স্বতঃই শুধায়।-
হায় যে দরিদ্র জন থাকে কিসে তবে
দেবতার পূজা হ’তে চিরই বঞ্চিত?
সে কি তুচ্ছ দেবতার কাছে, যদি সঁপে
সে তাঁরে ধূলিরো মুষ্টি সভক্তি-সঞ্চিত?
কিন্তু সে দুৰ্ল্লভ ভক্তি আছে কি আমার,
যে মোহিনী মন্ত্রবলে নিমেষের মাঝে
ধূলিও ভরিয়া ওঠে রেণুতে সোণার,
কুসুমেরো কোমলতা কণ্টকে বিরাজে?
জানি আমি বিদ্রোহী এ হৃদয় আমার,
তুচ্ছ কারণেতে ওঠে অশান্ত হইয়া।
আলো হ’তে ফিরায়ে নয়ন আপনার
কাঁদে সে, আঁধার কেন আইল ছাইয়া!
এ অশান্ত, এ বিদ্রোহী হৃদয় আমার
যদি কভু লভে শান্তি নিমেষের তরে
সে তোমারি কাছে পিতা; ভালবাসিবার
যদি কেহ থাকে তার জগত ভিতরে
সে তুমি, সে তুমি পিতা। তুমি ছিলে তার
বাল্যের দেবতা, নাহি জানিত তথাপি
সে তখন তুমি কত মহৎ উদার;
গভীর বিস্তৃত কত তব জ্ঞানবাপী।
শুনি এবে মুখে তব যবে বসি’ কাছে
অসীম জ্ঞানের কথা,- ভুলি আপনারে।
শুধু ‘সেন্টিমেন্ট্যালিটী’ যত কিছু আছে
দুঃখ, সুখ,- তখন তা পারি বুঝিবারে।
তোমার বিশ্বাস দিয়া অলক্ষ্যে আমার
হৃদয়ে বিশ্বাস ওঠে গঠিত হইয়া।
যদিও সমতা রাখি সহিতে তাহার
অটল পারে না র’তে অবিরত হিয়া।
এই তুচ্ছ দুঃখ সুখে প্রতি দিবসের
সত্যের তীব্রতা তাই করে আস্বাদন,
ভুলে যায় কিছু নাই ভেদ এ দুয়ের-
আজিকার সত্য আর বাল্যের স্বপন।
* * * *
ধ্বনিত যে মনোবীণে সুর বিভিন্নতা,
শুধু তারি ছায়া এই কবিতা আমার।
তোমারে দিলাম ইহা; ইহাদের কথা;
যেমন বুঝিবে তুমি, কে বুঝিবে আর?
উদ্ভাসিত চন্দ্রকরে তটিনী যেমন,
তুমিও দেখিতে পাবে তেমনি ইহার
কত স্থলে হৃদি-আলো তোমারি আপন
পড়িয়াছে, করিয়াছে শোভার বিস্তার।
চিরস্নেহাস্পদ কন্যা-
মৃণালিনী।