অকাল-সন্ধ্যা

ব্যাসবাক্য মিথ্যা নয়।
পরবর্তী কবিরাও মৌসলপর্বের অন্ত্য ঘটনার বর্ণনায়
অসত্যের আশ্রয় নেননি। তাঁরা
যথাসাধ্য ব্যাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই
যা-কিছু বলবার বলেছেন।
ব্যাখ্যা বহুবিধ, কিন্তু তথ্য এক।
সত্যি সেই সংকটের মুহূর্তে একটিও
দিব্যাস্ত্র আমার
স্মৃতির সড়কে, অন্ধকারে
ভাসিত হয়নি।
ব্যাসবাক্য মিথ্যা নয়, সে-কথা আমার চাইতে বেশি আর কে জানে, তবুও
মাঝে-মাঝে
নিজেকে জিজ্ঞাসা করি,
স্মৃতিভ্রংশ না-হলেই আমি কি সেদিন
শরযোজনার জন্য
ধনুকে টান করে ছিলা পরাতে পারতুম?
স্মৃতিভ্রংশে নয়,
অন্যত্র আমার লজ্জা, অন্যত্র আমার পরাজয়।

কুরুক্ষেত্র শান্ত, মহাযুদ্ধের আগুন
কবেই নিবেছে।
তবুও যাদের কথা ভেবে আমি সাগ্রহে আবার
পরেছি যুদ্ধের সজ্জা,
যাদের সম্মানরক্ষা করবার মানসে আমি গাণ্ডীবে সেদিন
জ্যারোপণ করতে গিয়েছিলুম, যখন
তারাই অনেকে-অগ্নিকুণ্ডের-উদ্দেশে-ধাবমান
মূর্খ পতঙ্গের মতো-
লাস্যভরে
লুঠেরা-দলের দিকে চলে গেল,
তখন, স্বীকার করি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার
শরসন্ধানের কোনো ইচ্ছাই ছিল না।

ব্যাসদেব আমাকে নিমিত্তমাত্র ভেবেছেন।
অন্যেরাও বিশ্বাস করেন, আমি
কৃষ্ণের ইচ্ছার
অধীন পুতুলমাত্র, তাঁরই অভিপ্রায়ে
একদা অসংখ্য মহারথীকে পরাস্ত করে তারপর
জীবনসন্ধ্যায়
সামান্য দস্যুর হাতে পরাস্ত হয়েছি, এতে
আমার গৌরব কিংবা অগৌরব- কোনোটাই নেই।
কিন্তু যদি তা-ই হবে, তা হলে এখনও
এত শত বর্ষ যুগ অতিক্রান্ত হবার পরেও
পিছনে তাকালে
চোখের ভিতরে কেন জ্বালা করে ওঠে? কেন
সেই দূর ধূসর সন্ধ্যার স্মৃতি আজও
তীক্ষ্ণ শলাকার মতো
বুকের ভিতরে বিঁধে আছে?

কৃষ্ণ, তুমি যেখানেই থাকো,
জেনে রাখো,
নিতান্ত নিমিত্ত নই, আমারও উদ্যম
অথবা নৈরাশ্য বলে কিছু ছিল;
ইচ্ছা ও অনিচ্ছা ছিল। জেনে রাখো,
অর্জিত বিশ্রাম ছেড়ে যাদের রক্ষার জন্য আমি
প্রবীণ বয়সে
তপ্ত বালুকার পথ, নদী ও পাহাড়
পার হয়ে ছুটে গিয়েছিলুম সমুদ্রতীরে, তারা অনেকেই
অর্জুনের হাত ধরে
নিরাপদ ভূমিতে উত্তীর্ণ হতে চায়নি, অনেকে
সেই ঘোর সংকটের মুহূর্তে সেদিন-
অর্জুনকে নয়-
অরণ্যের একদল আভীর দস্যুকে
প্রাপণীয় প্রেমিকপুরুষ বলে সাগ্রহে বরণ করেছিল।

জেনে রাখো,
কোথায় আমার লজ্জা, কোথায় আমার পরাজয়।

না, কোনো তস্কর কিংবা দস্যু নয়,
ব্যাখ্যার অতীত সেই অকাল-সন্ধ্যায়
কোনো লুঠেরার হাতে অর্জুন সেদিন পঞ্চনদের অঞ্চলে
পরাস্ত হয়নি।
যাদের জয়ের জন্য অশক্ত শরীরে আমি গাণ্ডীবের ছিলা
টান্ করে বাঁধতে গিয়েছিলুম, তারাই
আমাকে সেদিন
অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে দিয়েছে।

২২ চৈত্র, ১৩৭৬