কথোপকথন ১

শুভঙ্কর
আমার নির্মাণ কাজে আর কেন পাইনা তোমাকে?
আমার নির্মাণ কাজও বেঁকে গেছে তাই অন্য মুখে।

রথের চাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছো?
শুনতে পাচ্ছো ভাঙা হাড় কাৎরাচ্ছে কেমন?
রথের চাকার ডাকে এখন শুয়েছি রাজপথে।
এ সময় অস্থিহীন
তার এক দধীচিকে চাই।

তোমাকে দিয়েছি সব,
দিইনি কেবল
এই অস্থিখণ্ডগুলি, যা বজ্রের স্বরলিপি জানে ।

বৃহৎ বিশ্বের জন্যে
এ আমার সামান্যই দান।

নন্দিনী
কী করে যে এত বদলালে!
তোমার আগের ভাষা হারিয়ে গিয়েছে।
তুমিও বয়স্ক হলে,
নত হলে জরার শাসনে?

অথচ আমার চোখে
এখনো মুকুট পরা তুমি।
তোমার মাথার পরে রাজছত্র টাঙানো এখনো।

যে সব নক্ষত্র আজো পূর্বপুরুষের
মনস্বীতার আলো নিজেদের হাড়ে-মাসে জীইয়ে রেখেছে
শালিকের চড়ুয়ের মতো তারা উড়ে উড়ে ছুটে ছুটে আসে
তোমার চোখের মধ্যে
স্থায়ী কোন ঠিকানার ঘরবাড়ি গড়বার টানে।

কি পাওনি যে এত অভিমান?

শুভঙ্কর
কোন বীজ না রেখেই
আমি চাইব বড় হোক আমার নিজস্ব অভিমান।
এই জঙ্গলের দেশ
বিশল্যকরণীহীন দেশ
আরো রক্তক্ষত হোক কাঁটায় কাঁটায় বিষে বিষে
চাইব না কখনো।

কোন বীজ না রেখেই
চলে যাব, অত্যন্ত গোপনে
যেখানে মহান সব বৃক্ষ কিংবা ঔষধিলতারা
বিশ্বভুবনের জন্যে জ্বেলে যাচ্ছে আকাশ-প্রদীপ।

নন্দিনী
সর্বস্বের উপহার দিলে যদি এই ধ্বংসস্রোত
রাখো যেত, অবশ্য দিতাম।

আমার সর্বস্ব আর আগেকার রাজবাড়ি নেই।
কোঅপারেটিভ সব ফ্ল্যাটের মতন
সেখানে অসংখ্য অংশীদার।

এইটা স্বামীর আর ঐগুলো
শিশু সন্তানের।
এটা বৃদ্ধা শাশুড়ির
এদিকের-ওদিকের আরো সব কুঠরি-কোঠর
আত্মীয়-স্বজনে ভাগাভাগি।

দ্রৌপদীর মতো আমি
যদিও তা ভিন্ন অর্থে, নিশ্চয় বুঝেছ।
তোমাকে আগের মতো সর্বস্ব দেওয়ার সাধ্য নেই।
তবু পারি, তবু পারি,
স্রোতস্বিনী ভাঁটায় মরে না।

আমার শরীর থেকে সমস্ত আগুন চুরি করে
একদিন মৃগয়ায় জয়ী হয়েছিলে।
আজ আমি অন্য এক আগুনের ধূপ দীপ সব জ্বেলে দেব।
কত ঊর্মিরোল পেলে
বলো তুমি, ভুলবে প্রস্থান?

শুভঙ্কর
কেউ কি আমাকে চায়,
আমি কি কারোর প্রয়োজন?

শতাব্দীর অর্ধেকেরও চেয়ে বেশি সময় একাকী
অনর্গল গড়ে গেছি উৎসবের যথাযথ সাজ।
লাল নীল সবুজের পতাকা কেটেছি কাঁচি দিয়ে
হলুদ ও বেগুনির ঝালর কেটেছি কাঁচি দিয়ে
সোনালি রুপোলি রাংতা
চাঁদমালায় এঁটে গেছি রাত জেগে জেগে।

যে সব উঠোন ফাঁকা,
তার জন্যে মাদুরি বা চাটাই বুনেছি।
যে সব বাগান ফাঁকা
গোলাপের, মুশাণ্ডার, মালতীর, রজনীগন্ধার
টব এনে সাজিয়ে দিয়েছি।

সেই সব আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিনি কখনো
যেখানে পদক নেই,
পরিবর্তে দংশন রয়েছে।
কবে কোন ঝড়ে আমি ছুটে যাইনি বলো
উল্কা হয়ে, অভিমন্যু হয়ে?
অথচ আজকে আমি কারো নই,
অসংখ্য কুটি যেন মাথার উপরে জ্বলছে ঝাড়লণ্ঠন।

নন্দিনী
ছিঃ শুভঙ্কর,
তুমি বুঝি শোকাতুর নগদ বিদায় পাওনি বলে?

এত জেনে, এত সব ইতিহাস পড়ে,
কী করে ভাবতে পারলে সার্থকতা কিংবা দিগ্বিজয়
ঘাসফড়িংয়ের মতো তুড়িলাফে হাঁটে?
দুটো-একটা সমুজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়তো রয়েছে,
আর্য প্রয়োগের মতো তারা ঠিক নিয়মে আসে না।

ইতিহাস চিরদিন মানুষের পরেকের গর্ত গুনে গুনে
মানব চিনেছে।