কথোপকথন ১১

শুভঙ্কর
শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের
‘চার অধ্যায়’ দেখেছ নিশ্চয়।
আজো তার উত্তাপের আঁচ
স্মৃতির পরত ছুঁয়ে আছো।

শ্রীরঙ্গমে প্রথম রজনী
পরম সৌভাগ্য যাকে বলে!
বিরল সে উন্মোচন যেন
আচমকা আয়নায় মেলে দিল
আমাদেরই আহত প্রহর।

সময়ের সব রুদ্ধস্রোত
সমস্ত বধির-হওয়া বাক্‌
ভস্মে ঢাকা সমস্ত কল্লোল
সংগ্রামের ভুল হাঁড়িকাঠে
উৎসর্গ ও আত্মদান যত
সব চেনা হয়ে যেতে থাকে
প্রহারের মতন স্বননে
কবেকার লেখা ঐ রবীন্দ্রনাথের
অবাক আশ্চর্য রচনায়।

এখনো শিউরে উঠি, ঐ
ভিতরে সে হুইসেল বাজাল।
অর্থাৎ নির্দেশ প্রস্তুতির
যজ্ঞাগ্নিতে মরণঝাঁপের।

আমার অতীত নেই কোন
শুধুই আবর্ত-বর্তমান।
আমার শিকড় আঁকড়ে নেই
বোধের কঠিন ভূমিতল।
আমাকে জড়িয়ে নেই শ্বাস
সে শ্বাসে কমলকলি ফোটে
রক্তের গোপন গর্ভগৃহে,
যে কমলকলি পেতে চায়
দ্বিতীয় সত্তার আলিঙ্গন,
দ্বিতীয় সত্তার অভ্যন্তরে
খুঁজে পায় মোহরে মোহরে
সাজানো ভরাট গুপ্তধন।
আমি শুধু রক্তের, রণের,
আকাঙ্খিত বিসর্জনেরও।

তারুণ্য উৎসব হতে চেয়ে
নিয়েছিল ব্যাধের ব্রতকে।
বধ্যভূমি দীর্ঘ হতে থাকে
সন্ত্রাস সূর্যকে ছিঁড়ে ফেলে।
অবশেষে ঘরে ফিরে আসা
আত্মদীর্ণ, স্তূপাকার করা
শবদেহ গণ-কবরের
গহ্বরে গহ্বরে শুতে যায়,
উর্বরতা শুষে নেয় মাটি।

প্রহর শেষের আলো নামে
তার কোন মুখাকৃতি নেই
তার চোখ পাথরের চোখ
তার চুলে গরল গড়ায়।

কোথায় যে ছিল দেবযান,
হঠাৎ আমার সমানে তুমি।
দেখেই আপাদ চমকে উঠি
এত এলা, এত অন্তুর
গলার বরণমালাখানি
এবং অচির-সর্বনাশ।

নন্দিনী
বাজে কথা রাখো, মোটেই ভাবনি সেটা
প্রথম চিঠিতে লিখেছিলে, মনে আছে
তোমাকে দেখলে ‘গোরা’-র পাতার থেকে
রক্ত-শরীরে সুচরিতা জেগে ওঠে।
লেখ নি।

শুভঙ্কর
হতে পারে। ভয় পেয়ে গিয়ে
চেয়েছি এলার মূর্তি মুছে
তোমাকে সাজাতে অন্যরূপে।
শুধু সুচরিতা হবে কেন?
একবার কুমুও বলেছি।
কিন্তু মূলত এলা তুমি,
কুমু নয়, সুচরিতা নয়।
কেবল এলাই পেরেছিল
আগুনের কল্‌লকে্‌ শিখার
গণ্ডীর ভিতের অনির্ভয়
বাসরশয্যাকে গড়ে নিতে।
বলো কবে আর কোন্‌ নারী,
যখন শিয়রে মৃত্যু খাড়া, তার শেষ চুম্বনখানিকে
অফুরাণ করে দিয়ে গেছে?

নন্দিনী
এলা অগ্নিদীপ, এলা ধ্বংসের বেদীতে মূর্ত প্রাণ
তার জ্বালা, তার জ্বলা এলোকেশি মেঘের বিদ্যুৎ,
তাকে ভাবলে শিউরে-ওঠা রক্তে হিম ঝরে।

আমি তো কুমুরই মতো, বিদ্রোহকে গোপন করেছি।
পা রেখেছি মখমলে, মেনেছি খাঁচার অধীনতা।

তবে এও ঠিক আমি সুচরিতা পার হয়ে এসে
কুমুরই ভিতর থেকে লুকনো অগ্নির বীজকণা
প্রথম কুড়োই, রাখি গোপন কৌটোয় মুখ এঁটে।
সে ছিল প্রস্তুতিপর্ব, যদি কোনদিন ডাক দেয়
যজ্ঞের আহুতি, আমি এলা হয়ে যেতে পারি যাতে।
কিন্তু এলা হতে তো পারিনি।

শুভঙ্কর
হও বা না হও, তুমি এলা
বন্ধন মেনেছ, ছিঁড়বে বলে।
তোমার ধর্মই জুড়ে দেওয়া
সর্বনাশের স্রোতে সাঁকো।

আমি তো কখনো ভুলব না
কী অমাবস্যায় এসেছিলে,
ফুরিয়ে যাওয়ার দিকে ঝুঁকে
তখন আমার শেষ সীমা,
পাথরের ভারে কুঁজো হয়ে
চৌচির নিসর্গে গুনে যাই
পতনের পদধ্বনি শুধু।

নন্দিনী
এলা অন্তু খলো ঢের হয়েছে এবার তুমি থামো।
আমি অত দাতা নই কিছু না পাওয়ার বিনিময়ে
অন্যকে সাজিয়ে দেব উপঢৌকনের ঝর্না ঢেলে।

তোমার আয়নায় আমি নিজেকে দেখেছি যেই দিন
সেদিনই মরাল তার উড়বার ডানা ফিরে পেল।
তুমি না আকাশ দিলে কে জানত এ উড়ানের সুখ?