কথোপকথন ১২

বেগম আখতার বাজছে পাশের বাড়িতে
দুহাজার বছরের পুরনো মেঘের পাখোয়াজে
বৃষ্টির তানপুরা, সেই যুগলবন্দীর রাত, জুঁয়ে-মোড়া বিবাহবাসর
ফিরে আসে জেলখানা ভেঙে।
কোন একদিন শূন্য করতল উপছিয়ে ছিল যত পিপাসার জল
ফিরে আসে সীর্ন সমতলে
সসাগরা হতে চায়, পাথর গড়ায় খরস্রোতে।

স্মৃতি জাগে, জড়ানো পটের স্মৃতি খোলে।
বৃক্ষ এক, বৃক্ষ দুই, বৃক্ষ দশ, বৃক্ষ শতাধিক।
ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ হয় বনপথ
অবচেতনার মতো জটিলতা, গিঁট যা খোলে না।
মায়াহরিণের ছায়া আসে যায় হিমের আড়ালে।
ছায়া ক্রমে আরো গাঢ়, নৈব্যক্তিক নয়,
ঈর্ষাতুর, জ্যোৎস্না বা রোদের
সৃজন-সুষমা দেখে কেউ মুগ্ধ হোক
অভিপ্রেত নয়, তাই স্লুইস গেটের দরজা চাবি দিয়ে আঁটা
তবু স্মৃতি সিনেমা-ক্যামেরা, জুমে-আঁটা, ট্রলিতে চাপানো।
এবং হঠাৎ পর্দা সরে যেতে থাকে
আলোর প্রভাব বাড়ে, বহুস্তর খুলে যেতে যেতে
অকস্মাৎ যেন আবির্ভাব
অগ্নি উত্তরীয় পরে মঞ্চে আসে চিরঋষি আলোর পাহাড়।

বেগম আখতার শুনি
শুনতে শুনতে সত্যি মনে হয়
অশ্রুও স্বাধীনচেতা
অশ্রুরও রয়েছে বেশ স্পষ্ট নির্বাচন,
সরু তারে বাঁধা প্রতিবাদ।

বেগম আখতার চুপ পাশের বাড়িতে।
কলকাতার বালতি মগ, বাথরুমের টিনের দরজা
অসুখের কণ্ঠস্বরে সুখের কথার হাসাহাসি
ভাকে কেন মাছি কেন বাড়া ভাতে মাছি
এখনো ফুটল না দুধ? বাবার ওষুধ কে রেখেছে?

জুতোর ঘসটানি, শিশু আছড়ে কাঁদে, নতুন বৌ এর
ঘোমটা খসে খসে পড়ে কাঁসার বাসনে, কেরোসিনে
সংসার উনোনমুখী, উনোনের কড়ায়ে ডেকচিতে
সরষের তেলের দর্প, আনাজের চূর্ণ অভিমান।
এই শব্দোদগার, এই অবাক অর্কেস্ট্রা, এই
হাঁচি-কাশি-কলহের জটিল সোনাটা
বেঠোফেন শোনেনি কখনো।

তুমি কি এখন স্নানে?
শাওয়ারের প্রপাতের নীল জলে তোমার লুণ্ঠন?
তোমার শরীর ওরা সকেলের আগে ছুঁয়ে নিল
আমাকে যা দিতে দ্বিধা, কী সহজে তার বিসর্জন।
নাকি তুমি পড়ার টেবিলে?
কলমে ভরছ কালি, নাকি টানছ আন্ডারলাইন
গভীর বাক্যের নিচে, নাকি মানচিত্রে ঝুঁকে খুঁজছ সেই দেশ
পাথরে লুকনো থাকে সোনা?
সব বই ঠেলে দিয়ে এখনো রয়েছি ডুবে
বেগম আখতারে।
বেগম আখতার মানে তোমারি আয়নায় খোঁজাখুঁজি
আমার যে সব দিন ভেসে গেছে শ্রাবণগাথায়।
যত খুঁজি, একই ফটোগ্রাফ,
পাহাড় ও সাগরের চুম্বনের মাঝখানে তুমি
আমার ইচ্ছের নৌকা ডুবে যায়, পৌছতে পারে না।

কোথাও বকুল ঝরে চলেছে শহরে, গলা নিচে
বকুল-ঝরানো হাওয়া
দুঃখে-কষ্টে প্রাজ্ঞ হতে থাকে।