আকন্দ

সন্ধ্যা আলোর সোনার খেয়া পাড়ি যখন দিলো গগন পারে
অকূল অন্ধকারে,
ছম্ছমিয়ে এলো রাতি ভুবন-ডাঙার মাঠে
এক্লা আমি গোয়ালপাড়ার বাটে।
নতুন-ফোটা গানের কুঁড়ি দেবো ব’লে দিনুর হাতে আনি
মনে নিয়ে সুরের গুন্গুনানি
চ’লেছিলেম, এমন সময় যেন সে কোন্ পরীর কণ্ঠখানি
বাতাসেতে বাজিয়ে দিলো বিনা-ভাষার বাণী;
ব’ল্লে আমায় “দাঁড়াও ক্ষণেক তরে,
ওগো পথিক তোমার লাগি’ চেয়ে আছি যুগে যুগান্তরে।
আমায় নেবে চিনে।
সেই সুলগন এলো এত দিনে।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে আমি, মনে গোপন আশা,
কবির ছন্দে বাঁধ্বো আমার বাসা।”
দেখা হ’লো, চেনা হ’লো সাঁঝের আঁধারেতে,
ব’লে এলেম, তোমার আসন কাব্যে দেবো পেতে।
সেই কথা আজ প’ড়্লো মনে হঠাৎ হেথায় এসে
সাগর-পারের দেশে,-
মন-কেমনের হাওয়ার পাকে অনেক স্মৃতি বেড়ায় মনে ঘুরে
তা’রি মধ্যে বাজ্লো করুণ সুরে
“ভুলো না গো ভুলো না এই পথ-বাসিনীর কথা,
আজো আমি দাঁড়িয়ে আছি, বাসা আমার কোথা?”
শপথ আমার, তোমরা বোলো তা’রে
তা’র কথাটি দাঁড়িয়েছিলো মনের পথের ধারে,-
বোলো তা’রে চোখের দেখা ফুটেছে আজ গানে,-
লিখন খানি রাখিনু এইখানে।

যেদিন প্রথম কবি-গান
বসন্তের জাগালো আহ্বান
ছন্দের উৎসব সভা-তলে
সেদিন মালতী যুথী জাতি
কৌতুহলে উঠেছিলো মাতি’
ছুটে এসেছিলো দলে দলে।
আসিল মল্লিকা চম্পা কুরুবক কাঞ্চন করবী,
সুরের বরণ-মাল্যে সবারে বরিয়া নিলো কবি।
কি সঙ্কোচে এলে না যে, সভার দুয়ার হ’লো বন্ধ।
সব পিছে রহিলে আকন্দ।।

মোরে তুমি লজ্জা করো নাই,
আমার সম্মান মানি তাই,
আমারে সহজে নিলে ডাকি’।
আপনারে আপনি জানালে;
উপেক্ষার ছায়ার আড়ালে
পরিচয় রাখিলে না ঢাকি’।
মনে পড়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা চ’লেছিনু একা,
তুমি বুঝি ভেবেছিলে কি জানি না পাই পাছে দেখা,
অদৃশ্য লিখনখানি, তোমার করুণ ভীরু গন্ধ
বায়ু ভরে পাঠালে আকন্দ।।

হিয়া মোর উঠিল চমকি’
পথ মাঝে দাঁড়ানু থমকি’,
তোমারে খুঁজিনু চারিধারে।
পল্লবের আবরণ টানি’
আছিলে কাব্যের দুয়োরাণী
পথ-প্রান্তে গোপন আঁধারে।
সঙ্গী যারা ছিল ঘিরে তা’রা সবে নাম-গোত্রহীন
কাড়িতে জানে না তা’রা পথিকের আঁখি-উদাসীন।
ভরিল আমার চিত্ত বিস্ময়ের গভীর আনন্দ
চিনিলাম তোমারে আকন্দ।।

8

দেখা হয় নাই তোমা সনে
প্রাসাদের কুসুম কাননে,
জনতার প্রগল্ভ আদরে।
নিদ্রাহীন প্রদীপ আলোকে
পড়োনি অশান্ত মোর চোখে
প্রমোদের মুখর বাসরে।
অবজ্ঞার নির্জ্জনতা তোমারে দিয়েছে কাছে আনি’,
সন্ধ্যার প্রথম তারা জানে তাহা, আর আমি জানি
নিভৃতে লেগেছে প্রাণে তোমার নিঃশ্বাস মৃদু মন্দ,
নম্র-হাসি উদাসী আকন্দ।।

আকাশের একবিন্দু নীলে
তোমার পরাণ ডুবাইলে,
শিখে নিলে আনন্দের ভাষা।
বক্ষে তব শুভ্র রেখা এঁকে
আপন স্বাক্ষর গেছে রেখে
রবির সুদূর ভালোবাসা।
দেবতার প্রিয় তুমি, গুপ্ত রাখো গৌরব তোমার,
শান্ত তুমি, তৃপ্ত তুমি, অনাদরে তোমার বিহার।
জেনেছি তোমারে, তাই জানাতে রচিনু এই ছন্দ
মৌমাছির বন্ধু হে আকন্দ।।

চাপাড্ মালাল্,
১৬ ডিসেম্বর, ১৯২৪।