আশীর্বাদী

কল্যাণীয়া অমলিনার প্রথম বার্ষিক জন্মদিনে

তোমারে জননী ধরা
দিল রূপে রসে ভরা
প্রাণের প্রথম পাত্রখানি,
তাই নিয়ে তোলাপাড়া
ফেলাছড়া নাড়াচড়া
অর্থ তার কিছুই না জানি।
কোন্ মহারঙ্গশালে
নৃত্য চলে তালে তালে,
ছন্দ তারি লাগে রক্তে তব।
অকারণ কলরোলে
তাই তব অঙ্গ দোলে,
ভঙ্গি তার নিত্য নব নব।
চিন্তা-আবরণ-হীন
নগ্নচিত্ত সারাদিন
লুটাইছে বিশ্বের প্রাঙ্গণে,
ভাষাহীন ইশারায়
ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায়
যাহা-কিছু দেখে আর শোনে।
অস্ফুট ভাবনা যত
অশথপাতার মতো
কেবলই আলোয় ঝিলিমিলি।
কী হাসি বাতাসে ভেসে
তোমারে লাগিছে এসে,
হাসি বেজে ওঠে খিলিখিলি।
গ্রহ তারা শশী রবি
সমুখে ধরেছে ছবি
আপন বিপুল পরিচয়।
কচি কচি দুই হাতে
খেলিছ তাহারি সাথে,
নাই প্রশ্ন, নাই কোনো ভয়।
তুমি সর্ব দেহে মনে
ভরি লহ প্রতিক্ষণে
যে সহজ আনন্দের রস,
যাহা তুমি অনায়াসে
ছড়াইছ চারিপাশে
পুলকিত দরশ পরশ,
আমি কবি তারি লাগি
আপনার মনে জাগি,
বসে থাকি জানালার ধারে।
অমরার দূতীগুলি
অলক্ষ্য দুয়ার খুলি
আসে যায় আকাশের পারে।
দিগন্তে নীলিম ছায়া
রচে দূরান্তের মায়া,
বাজে সেথা কী অশ্রুত বেণু।
মধ্যদিন তন্দ্রাতুর
শুনিছে রৌদ্রের সুর,
মাঠে শুয়ে আছে ক্লান্ত ধেনু।
চোখের দেখাটি দিয়ে
দেহ মোর পায় কী এ,
মন মোর বোবা হয়ে থাকে।
সব আছে আমি আছি,
দুইয়ে মিলে কাছাকাছি
আমার সকল-কিছু ঢাকে।
যে আশ্বাসে মর্ত্যভূমি
হে শিশু, জাগাও তুমি,
যে নির্মল যে সহজ প্রাণে,
কবির জীবনে তাই
যেন বাজাইয়া যাই
তারি বাণী মোর যত গানে।
ক্লান্তিহীন নব আশা
সেই তো শিশুর ভাষা
সেই ভাষা প্রাণদেবতার,
জরার জড়ত্ব ত্যেজে
নব নব জন্মে সে যে
নব প্রাণ পায় বারম্বার।
নৈরাশ্যের কুহেলিকা
উষার আলোকটিকা
ক্ষণে ক্ষণে মুছে দিতে চায়,
বাধার পশ্চাতে কবি
দেখে চিরন্তন-রবি
সেই দেখা শিশুচক্ষে ভায়।
শিশুর সম্পদ বয়ে
এসেছ এ লোকালয়ে,
সে সম্পদ থাক্ অমলিনা।
যে-বিশ্বাস দ্বিধাহীন
তারি সুরে চিরদিন
বাজে যেন জীবনের বীণা।

দার্জিলিং
৮ কার্তিক, ১৩৩৮