আতঙ্ক

বটের জটায় বাঁধা ছায়াতলে
গোধূলিবেলায়
বাগানের জীর্ণ পাঁচিলেতে
সাদাকালো দাগগুলো
দেখা দিত ভয়ংকর মূর্তি ধরে।
ওইখানে দৈত্যপুরী,
অদৃশ্য কুঠুরি থেকে তার
মনে-মনে শোনা যেত হাঁউমাউখাঁউ।
লাঠি হাতে কুঁজোপিঠ
খিলিখিলি হাসত ডাইনিবুড়ী।
কাশিরাম দাস
পয়ারে যা লিখেছিল হিড়িম্বার কথা
ইট-বের-করা সেই পাঁচিলের ‘পরে
ছিল তারি প্রত্যক্ষ কাহিনী।
তারি সঙ্গে সেইখানে নাককাটা সূর্পণখা
কালো কালো দাগে
করেছিল কুটুম্বিতা।

সতেরো বৎসর পরে
গিয়েছি সে সাবেক বাড়িতে।
দাগ বেড়ে গেছে,
মুগ্ধ নতুনের তুলি পুরোনোকে দিয়েছে প্রশ্রয়।
ইঁটগুলো মাঝে-মাঝে খসে গিয়ে
পড়ে আছে রাশকরা।
গায়ে গায়ে লেগেছে অনন্তমূল,
কালমেঘ লতা,
বিছুটির ঝাড়;
ভাঁটিগাছে হয়েছে জঙ্গল।
পুরোনো বটের পাশে
উঠেছে ভেরেণ্ডাগাছ মস্তবড়ো হয়ে।
বাইরেতে সূর্পণখা-হিড়িম্বার চিহ্নগুলো আছে,
মনে তারা কোনোখানে নেই।

স্টেশনে গেলেম ফিরে একবার খুব হেসে নিয়ে
জীবনের ভিত্তিটার গায়ে
পড়েছে বিস্তর কালো দাগ,
মূঢ় অতীতের মসীলেখা;
ভাঙা গাঁথুনিতে
ভীরু কল্পনার যত জটিল কুটিল চিহ্নগুলো।
মাঝে-মাঝে
যেদিন বিকেলবেলা
বাদলের ছায়া নামে
সারি সারি তালগাছে
দিঘির পাড়িতে,
দূরের আকাশে
স্নিগ্ধ সুগম্ভীর
মেঘের গর্জন ওঠে গুরুগুরু,
ঝিঁ ঝিঁ ডাকে বুনো খেজুরের ঝোপে,
তখন দেশের দিকে চেয়ে
বাঁকাচোরা আলোহীন পথে
ভেঙেপড়া দেউলের মূর্তি দেখি;
দীর্ণ ছাদে, তার জীর্ণ ভিতে
নামহীন অবসাদ,-
অনির্দিষ্ট শঙ্কাগুলো নিদ্রাহীন পেঁচা,
নৈরাশ্যের অলীক অত্যুক্তি যত,
দুর্বলের স্বরচিত শত্রুর চেহারা।
ধিক্ রে ভাঙনলাগা মন,
চিন্তায় চিন্তায় তোর কত মিথ্যা আঁচড় কেটেছে।
দুষ্টগ্রহ সেজে ভয়
কালোচিহ্নে মুখভঙ্গি করে।
কাঁটা-আগাছার মতো
অমঙ্গল নাম নিয়ে
আতঙ্কের জঙ্গল উঠেছে।
চারিদিকে সারি সারি জীর্ণ ভিতে
ভেঙেপড়া অতীতের বিরূপ বিকৃতি।
কাপুরুষে করিছে বিদ্রূপ।

২৩ জুলাই, ১৯৩২