বঙ্গবীর

ভুলুবাবু বসি পাশের ঘরেতে
নামতা পড়েন উচ্চস্বরেতে
হিস্ট্রি-কেতাব লইয়া করেতে
কেদারা হেলান দিয়ে।
দুই ভাই মোরা সুখে সমাসীন,
মেজের উপরে জ্বলে কেরাসিন,
পড়িয়া ফেলেছি চ্যাপ্টার তিন-
দাদা এমে, আমি বিএ।

যত পড়ি তত পুড়ে যায় তেল,
মগজে গজিয়ে উঠে আক্কেল-
কেমন করিয়া বীর ক্রমোয়েল
পাড়িল রাজার মাথা,
বালক যেমন ঠেঙার বাড়িতে
পাকা আমগুলো রহে গো পাড়িতে-
কৌতুক ক্রমে বাড়িতে বাড়িতে
উলটি ব’য়ের পাতা।

কেহ মাথা ফেলে ধর্মের তরে,
পরহিতে কারো মাথা খ’সে পড়ে,
রণভূমে কেহ মাথা রেখে মরে
কেতাবে রয়েছে লেখা।
আমি কেদারায় মাথাটি রাখিয়া
এই কথাগুলি চাখিয়া চাখিয়া
সুখে পাঠ করি থাকিয়া থাকিয়া-
প’ড়ে কত হয় শেখা!

পড়িয়াছি বসে জানালার কাছে
জ্ঞান খুঁজে কারা ধরা ভ্রমিয়াছে,
কবে মরে তারা মুখস্থ আছে
কোন্ মাসে কী তারিখে।
কর্তব্যের কঠিন শাসন
সাধ ক’রে কারা করে উপাসন,
গ্রহণ করেছে কণ্টকাসন-
খাতায় রেখেছি লিখে।

বড়ো কথা শুনি, বড়ো কথা কই,
জড়ো করে নিয়ে পড়ি বড়ো বই-
এমনি করিয়া ক্রমে বড়ো হই,
কে পারে রাখিতে চেপে!
কেদারায় বসে সারাদিন ধরে
বই প’ড়ে প’ড়ে মুখস্থ ক’রে
কভু মাথা ধরে, কভু মাথা ঘোরে-
বুঝি বা যাইব খেপে।
ইংরেজ চেয়ে কিসে মোরা কম!
আমরা যে ছোটো সেটা ভারি ভ্ৰম-
আকারপ্রকার রকম-সকম
এতেই যা কিছু ভেদ।
যাহা লেখে তারা তাই ফেলি শিখে,
তাহাই আবার বাংলায় লিখে
করি কতমতো গুরু-মারা টিকে-
লেখনীর ঘুচে খেদ।

মোক্ষমুলর বলেছে ‘আর্য’,
সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,
মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য-
আরামে পড়েছি শুয়ে।
মনু নাকি ছিল আধ্যাত্মিক-
আমরাও তাই, করিয়াছি ঠিক-
এ যে নাহি বলে ধিক্ তারে ধিক্,
শাপ দি পইতে ছুঁয়ে।

কে বলিতে চায় মোরা নহি বীর,
প্রমাণ যে তার রয়েছে গভীর,
পূর্বপুরুষ ছুঁড়িতেন তীর-
সাক্ষী বেদব্যাস।
আর কিছু তবে নাহি প্রয়োজন,
সভাতলে মিলে বারো-তেরো জন
শুধু তরজন আর গরজন
এই করো অভ্যাস।

আলোচাল আর কাঁচ-কলা ভাতে
মেখেচুখে নিয়ে কদলীর পাতে
ব্রহ্মচর্য পেত হাতে হাতে
ঋষিগণ তপ ক’রে-
আমরা যদিও পাতিয়াছি মেজ,
হোটেলে ঢুকেছি পালিয়ে কালেজ,
তবু আছে সেই ব্রাহ্মণতেজ
মনু তর্জমা প’ড়ে।

সংহিতা আর মুর্গি-জবাই
এই দুটো কাজে লেগেছি সবাই,
বিশেষত এই আমরা ক’ ভাই-
নিমাই, নেপাল, ভুতো।
দেশের লোকের কানের গোড়াতে
বিদ্যেটা নিয়ে লাঠিম ঘোরাতে,
বক্তৃতা আর কাগজ পোরাতে
শিখেছি হাজার ছুতো।
ম্যারাথন আর ধর্মপলিতে
কী যে হয়েছিল বলিতে বলিতে
শিরায় শোণিত রহে গো অলিতে
পাটের পলিতে-সম।
মূর্খ যাহারা কিছু পড়ে নাই
তারা এত কথা কী বুঝিবে ছাই!
হাঁ করিয়া থাকে, কভু তোলে হাই-
বুক ফেটে যায় মম।

আগাগোড়া যদি তাহারা পড়িত
গারিবাল্ডির জীবনচরিত
না জানি তা হলে কী তারা করিত
কেদারায় দিয়ে ঠেস্!
মিল ক’রে ক’রে কবিতা লিখিত,
দু-চারটে কথা বলিতে শিখিত,
কিছুদিন তবু কাগজ টিঁকিত-
উন্নত হত দেশ।

না জানিল তারা সাহিত্যরস,
ইতিহাস নাহি করিল পরশ,
ওয়াশিংটনের জন্মবরষ
মুখস্থ হল নাকো!
ম্যাট্সিনি-লীলা এমন সরেস
এরা সে কথার না জানিল লেশ-
হা অশিক্ষিত অভাগা স্বদেশ,
লজ্জায় মুখ ঢাকো।

আমি দেখো ঘরে চৌকি টানিয়ে
লাইব্রেরি হতে হিষ্ট্ৰি আনিয়ে
কত পড়ি, লিখি বানিয়ে বানিয়ে
শানিয়ে শানিয়ে ভাষা।
জ্বলে ওঠে প্রাণ, মরি পাখা ক’রে,
উদ্দীপনায় শুধু মাথা ঘোরে-
তবুও যা হোক স্বদেশের তরে
একটুকু হয় আশা।

যাক, পড়া যাক ‘ন্যাস্বি’ সমর-
আহা ক্রমোয়েল, তুমিই অমর।
থাক্ এইখেনে, ব্যথিছে কোমর-
কাহিল হতেছে বোধ।
ঝি কোথায় গেল, নিয়ে আয় সাবু।-
আরে আরে, এসো! এসো ননিবাবু!
তাস পেড়ে নিয়ে খেলা যাক গ্ৰাবু,
কালকের দেব শোধ।

[২১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৮৮]