দেউল

রচিয়াছিনু দেউল একখানি
অনেক দিনে অনেক দুখ মানি’।
রাখি নি তার জানালা দ্বার,
সকল দিক অন্ধকার,
ভূধর হ’তে পাষাণ ভার
যতনে বহি’ আনি’
রচিয়াছিনু দেউল একখানি।

দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে
ছিলাম চেয়ে তাহারি মুখপানে।
বাহিরে ফেলি এ ত্রিভুবন
ভুলিয়া গিয়া বিশ্বজন
ধেয়ান তারি অনুক্ষণ
করেছি এক প্রাণে,
দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে।

যাপন করি অন্তহীন রাতি
জ্বালায়ে শত গন্ধময় বাতি।
কনক-মণি-পাত্রপুটে,
সুরভি ধূপ-ধুম্র উঠে,
গুরু অগুরু-গন্ধ ছুটে,
পরাণ উঠে মাতি’।
যাপন করি অন্তহীন রাতি।

নিদ্রাহীন বসিয়া এক চিতে
চিত্র কত এঁকেছি চারি ভিতে।
স্বল্প সম চমৎকার
কোথাও নাহি উপমা তার,
কত বরণ, কত আকার
কে পারে বরণিতে,
চিত্র যত এঁকেছি চারি ভিতে!

স্তম্ভগুলি জড়ায়ে শত পাকে
নাগবালিকা গ্রীবা তুলিয়া থাকে।
উপরে ঘিরি চারিটি ধার
দৈত্যগুলি বিকটাকার,
পাষাণময় ছাদের ভার
মাথায় ধরি রাখে।
নাগবালিকা গ্রীবা তুলিয়া থাকে।

সৃষ্টিছাড়া সৃজন কত মত!
পক্ষীরাজ উড়িছে শত শত।
ফুলের মত লতার মাঝে
নারীর মুখ বিকশি রাজে,
প্রণয়ভরা বিনয়ে লাজে
নয়ন করি’ নত,
সৃষ্টিছাড়া সৃজন কত মত।

ধ্বনিত এই ধরার মাঝখানে
শুধু এ গৃহ শব্দ নাহি জানে।
ব্যাঘ্রাজিন আসন পাতি’
বিবিধরূপ ছন্দ গাঁথি’
মন্ত্র পড়ি দিবস রাতি
গুঞ্জরিত তানে,
শব্দহীন গৃহের মাঝখানে।

এমন করে গিয়েছে কত দিন
জানি নে কিছু আছি আপন-লীন।
চিত্ত মোর নিমেষ-হত
উৰ্দ্ধমুখী শিখার মত,
শরীর খানি মূর্চ্ছাহত
ভাবের তাপে ক্ষীণ।
এমন করে গিয়েছে কত দিন।

একদা এক বিষম ঘোর স্বরে
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে।
বেদনা এক তীক্ষ্ণতম
পশিল গিয়ে হৃদয়ে মম
অগ্নিময় সর্প সম
কাটিল অন্তরে।
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে।

পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি’,
গৃহের মাঝে দিবস উঠে ফুটি।
নীরব ধ্যান করিয়া চুর
কঠিন বাঁধ করিয়া দূর
সংসারের অশেষ সুর
ভিতরে এল ছুটি’,
পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি’।

দেবতাপানে চাহিমু একবার,
আলোক আসি পড়েছে মুখে তাঁর।
নূতন এক মহিমারাশি
ললাটে তাঁর উঠেছে ভাসি’,
জাগিছে এক প্রসাদ হাসি
অধর চারিধার।
দেবতাপানে চাহিনু একবার।

সরমে দীপ মলিন একেবারে
লুকাতে চাহে চির অন্ধকারে।
শিকলে বাঁধা স্বপ্নমত
ভিত্তি-আঁকা চিত্র যত
আলোক দেখি লজ্জাহত
পালাতে নাহি পারে,
সরমে দীপ মলিন একেবারে।

যে গান আমি নারিনু রচিবারে
সে গান আজি উঠিল চারিধারে।
আমার দীপ জ্বালিল রবি,
প্রকৃতি আসি আঁকিল ছবি,
গাঁথিল গান শতেক কবি
কতই ছন্দ হারে,
কি গান আজি উঠিল চারিধারে!

দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি’,
ভিতরে আর বাহিরে কোলাকুলি,
দেবের কর-পরশ লাগি’,
দেবতা মোর উঠিল জাগি’
বন্দী নিশি গেল সে ভাগি’
আঁধার পাখা তুলি’।
দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি’।

২৩ ফাল্গুন, ১২৯৯।