গান সমাপন

জনমিয়া এ সংসারে কিছুই শিখিনি আর
শুধু গাই গান।
স্নেহময়ী মা’র কাছে শৈশবে শিখিয়াছিনু
দুয়েকটি তান।
শুধু জানি তাই,
দিবানিশি তাই শুধু গাই।
শত ছিদ্র-ময় এই হৃদয়-বাঁশিটি ল’য়ে
বাজাই সতত,
দুঃখের কঠোর স্বর রাগিণী হইয়া যায়
মৃদুল নিঃশ্বাসে পরিণত।
আঁধার জলদ যেন ইন্দ্রধনু হয়ে যায়,
ভুলে যাই সকল যাতনা।
ভাল যদি না লাগে সে গান,
ভাল সখা, তা’ও গাহিব না!

এমন পণ্ডিত কত রয়েছেন শত শত
এ সংসার তলে,
আকাশের দৈত্য-বালা উন্মাদিনী চপলারে
বেঁধে রাখে দাসত্বের লোহার শিকলে।
আকাশ ধরিয়া হাতে নক্ষত্র-অক্ষর দেখি
গ্রন্থ পাঠ করিছেন তাঁরা,
জ্ঞানের বন্ধন যত ছিন্ন করে দিতেছেন,
ভাঙ্গি ফেলি অতীতের কারা।
কেহ বা বসিয়া আছে লক্ষীর পায়ের কাছে,
গণিছে রতন,
মাথার কিরীট হতে ছুটিছে রতন-বিভা,
জগৎ চাহিয়া আছে অবাক্ মতন।
আমি তার কিছুই করি না,
আমি তার কিছুই জানি না!
এমন মহান্ এ সংসারে
জ্ঞান রত্ন রাশির মাঝারে,
আমি দীন শুধু গান গাই,
তোমাদের মুখ পানে চাই;
আর আমি কিছুই জানি না!
ভাল যদি না লাগে সে গান
ভাল সখা, তাও গাহিব না!

বড় ভয় হ’ত, পাছে কেহই না দেখে তারে
যে জন কিছুই শেখে নাই।
ওগো সখা, ভয়ে ভয়ে তাই
যাহা জানি, সেই গান গাই!
তোমাদের মুখ পানে চাই।
শ্রান্ত দেহ হীনবল, নয়নে পড়িছে জল,
রক্ত ঝরে চরণে আমার,
নিশ্বাস বহিছে বেগে, হৃদয় বাঁশিটি মম
বাজে না-বাজে না বুঝি আর!
দিন গেল, সন্ধ্যা গেল, কেহ দেখিলে না চেয়ে
যত গান গাই!
বুঝি কারো অবসর নাই!
বুঝি কারো ভাল নাহি লাগে,
ভাল সখা আর গাহিব না!

কিছুই করি না আমি শুধু আমি গান গাই,
তা’ও আমি গাহিব না আর?
কেমনে কাটিবে দিন, কেমনে কাটিবে রাত,
হৃদয় আমার!
এ ভাঙ্গা বাঁশিটি মোর ধূলায় ফেলিয়া দিব,
একেলা পথের ধারে রহি
দেখিব পথিক যত ফিরিতেছে ইতস্ততঃ
ধনমান যশোভার বহি!
মলিন আমারে দেখি যদি কারো মনে পড়ে,
যদি কেহ ডাকে দয়া ক’রে,
যদি কেহ বলে শেষে, “যে একটি গান জান’
একবার শুনাওত মোরে;
গাহিতে চাহিব যত মনে পড়িবে না তত,
রুদ্ধ-কণ্ঠে আসিবে না গান,
আকুল নয়ন জলে হয়ত থামিতে হবে,
ধূলিতে পড়িব ম্রিয়মাণ।
একটি যা’গান জানি তাহাও যাইব ভূলি,
পথপ্রান্তে ধূলিময় দেহ।
সংসারের কোলাহল বুঝিতে নারিব কিছু
আমি যেন অতীতের কেহ।
ভাল সখা, তাই হোক্ তবে,
আর আমি গান গাহিব না!

সংসারের কেহই না- কিছুই না আমি,-
প্রাণ যবে ত্যজিবে এ দেহ,
কিছুই শিখিনি আমি, কিছু জানিতামনাক’
তা’ বলে কি কাঁদিবে না কেহ?
কেহই কি বলিবে না “একটি জানিত গান
বেড়াইত সেই গান গাহিয়া গাহিয়া,
দ্বারে দ্বারে মমতা চাহিয়া।
সে গান শোনেনি কেই তার,
মুছায়নি দুখ-অশ্রুধার,
মরণ সদয় হয়ে, গেছে তারে ডেকে লয়ে
শুনিতে একটি তার গান,
মুছাইতে সজল নয়ান।”