জীবনে নানা সুখ দুঃখের এলোমেলো ভীড়ের

জীবনে নানা সুখ দুঃখের
এলোমেলো ভিড়ের মধ্যে
হঠাৎ কখনো কাছে এসেছে
সুসম্পূর্ণ সময়ের ছোটো একটু টুক্রো।
গিরিপথের নানা পাথর-মুড়ির মধ্যে
যেন আচমকা কুড়িয়ে-পাওয়া একটি হীরে
কতবার ভেবেছি গেঁথে রাখব
ভারতীর গলার হারে;
সাহস করিনি,
ভয় হয়েছে কুলোবে না ভাষায়।
ভয় হয়েছে প্রকাশের ব্যগ্রতায়
পাছে সহজের সীমা যায় ছাড়িয়ে।
ছিলেম দার্জিলিঙে,
সদর রাস্তার নিচে এক প্রচ্ছন্ন বাসায়।
সঙ্গীদের উৎসাহ হোলো
রাত কাটাবে সিঞ্চল পাহাড়ে।
ভরসা ছিল না সন্ন্যাসী গিরিরাজের নির্জন সভার ‘পরে,-
কুলির পিঠের উপরে চাপিয়েছি নিজেদের সম্বল থেকেই
অবকাশ-সম্ভোগের উপকরণ।
সঙ্গে ছিল একখানা এসরাজ, ছিল ভোজ্যের পেটিকা,
ছিল হো হা করবার অদম্য উৎসাহী যুবক,
টাট্টুর উপর চেপেছিল আনাড়ি নবগোপাল,
তাকে বিপদে ফেল্বার জন্যে ছিল ছেলেদের কৌতুক।
সমস্ত আঁকাবাঁকা পথে
বেঁকে বেঁকে ধ্বনিত হোলো অট্টহাস্য।
শৈলশৃঙ্গবাসের শূন্যতা পূরণ করব ক’জনে মিলে,
সেই রস জোগান দেবার অধিকারী আমরাই
এমন ছিল আমাদের আত্মবিশ্বাস।
অবশেষে চড়াই-পথ যখন শেষ হোলো
তখন অপরাহ্ণের হয়েছে অবসান।
ভেবেছিলেম আমোদ হবে প্রচুর,
অসংযত কোলাহল উচ্ছ্বসিত মদিরার মতো
রাত্রিকে দেবে ফেনিল ক’রে।

শিখরে গিয়ে পৌছলেম অবারিত আকাশে,
সূর্য নেমেছে অস্ত-দিগন্তে
নদীজালের রেখাঙ্কিত
বহু দূর বিস্তীর্ণ উপত্যকায়।
পশ্চিমের দিগ্বলয়ে,
সুর-বালকের খেলার অঙ্গনে
স্বর্ণ-সুধার পাত্রখানা বিপর্যস্ত,
পৃথিবী বিহ্বল তার প্লাবনে।

প্রমোদমুখর সঙ্গীরা হোলো নিস্তব্ধ।
দাঁড়িয়ে রইলেম স্থির হয়ে।
এসরাজটা নিঃশব্দ পড়ে রইল মাটিতে,
পৃথিবী যেমন উন্মুখ হয়ে আছে
তার সকল কথা থামিয়ে দিয়ে।
মন্ত্ররচনার যুগে জন্ম হয়নি,
মন্দ্রিত হয়ে উঠল না মন্ত্র
উদাত্ত অনুদাত্তে।
এমন সময় পিছন ফিরে দেখি
সামনে পূর্ণচন্দ্র,
বন্ধুর অকস্মাৎ হাস্যধ্বনির মতো।
যেন সুরলোকের সভাকবির
সদ্যোবিরচিত কাব্য-প্রহেলিকা
রহস্যে রসময়।

গুণী বীণায় আলাপ করে প্রতিদিন।
একদিন যখন কেউ কোথাও নেই
এমন সময় সোনার তারে রুপোর তারে
হঠাৎ সুরে সুরে এমন একটা মিল হোলো
যা আর কোনোদিন হয়নি।
সেদিন বেজে উঠল যে-রাগিণী
সেদিনের সঙ্গেই সে মগ্ন হোলো
অসীম নীরবে।
গুণী বুঝি বীণা ফেললেন ভেঙে।
অপূর্ব সুর যেদিন বেজেছিল
ঠিক সেইদিন আমি ছিলেম জগতে
বলতে পেরেছিলেম-
আশ্চর্য।

শান্তিনিকেতন
৪ মে, ১৯৩৫