কালরাত্রে

কাল রাত্রে
বাদলের দানোয়-পাওয়া অন্ধকারে
বর্ষণের রিমঝিম প্রলাপে
চাপা দিয়েছিল
সন্ন্যাসী নিশীথের ধ্যানমন্ত্র।
জড়ত্বে ছিলেম পরাভূত,
ছিলেম উপবাসী;
ছিল শিথিলশক্তি ধূলিশয়ান।
বুকে ভর দিয়ে বসেছিল
সমস্ত আকাশের সঙ্গহীনতা।
“চাই চাই” করে কেঁদে উঠেছিল প্রাণ
প্রহরে প্রহরে নিশাচর পাখির মতো।
নানা নাম ধরেছিল ভিক্ষা,
অন্তরের অন্ধস্তরে শিকড় চালিয়েছিল
আঁকাবাঁকা অশুচি কান্নার।
“চাই চাই” বলে
শূন্য হাৎড়ে বেড়িয়েছিল রাত-কানা
যাকে চায় তাকে না জেনে।
শেষে ক্রুদ্ধ গর্জনে হেঁকে উঠল,
“নেই সে নেই কোথাও নেই।”
সত্যহারা শূন্যতার গর্ত থেকে
কালো কামনার সাপের বংশ
বেরিয়ে এসে জড়িয়েছে কাঙালকে-
নাস্তিত্বের-সেই-শিকল-বাঁধা ভৃত্যকে-
নিরর্থের বোঝায়
বেঁকেছে যার পিঠ,
নেমেছে যার মাথা।

ভোর হল রাত্রি।
আষাঢ়ের সকালে অকস্মাৎ হাওয়ায়
ঘন মেঘের দুর্গপ্রাচীর
পড়ল ভেঙেচুরে।
ছুটে বেরিয়ে এসেছে
প্রভাতের বাঁধন-ছেঁড়া আলো।
মুক্তির আনন্দঘোষণা
বেজে উঠল আকাশে আকাশে
আগুনের ভাষায়।
পাখিদের ছোটো কোমল তনুতে
দুরন্ত হয়ে উঠল প্রাণের উৎসুক ছন্দ।
চলল তাদের সুরের তীর-খেলা
কণ্ঠ থেকে কণ্ঠ, শাখা থেকে শাখায়।
সেতারের দ্রুত তালের বাজন যেন
পাতায় পাতায় আলোর চমক।
মন দাঁড়িয়ে উঠল;
বললে, আমি পূর্ণ।
তার অভিষেক হল
আপনারই উদ্বেল তরঙ্গে।
তার আপন সঙ্গ
আপনাকে করলে বেষ্টন
শিলাতটকে ঝর্নার মতো;
উপচে উঠে মিলতে চলল
চার দিকের সব-কিছুর মধ্যে।
চেতনার সঙ্গে আলোর রইল না কোনো ব্যবধান।
প্রভাতসূর্যের অন্তরে
দেখতে পেলেম আপনাকে
হিরন্ময় পুরুষ;
ডিঙিয়ে গেলেম দেহের বেড়া,
পেরিয়ে গেলেম কালের সীমা,
গান গাইলেম “চাই নে কিছু চাই নে”-
যেমন গাইছে রক্তপদ্মের রক্তিমা,
যেমন গাইছে সমুদ্রের ঢেউ,
সন্ধ্যাতারার শান্তি,
গিরিশিখরের নির্জনতা।

শান্তিনিকেতন
২৩ জুন, ১৯৩৬