কলুষিত

শ্যামল প্রাণের উৎস হতে
অবারিত পুণ্যস্রোতে
ধৌত হয় এ বিশ্বধরণী
দিবসরজনী।
হে নগরী, আপনারে বঞ্চিত করেছ সেই স্নানে,
রচিয়াছ আবরণ কঠিন পাষাণে।
আছ নিত্য মলিন অশুচি,
তোমার ললাট হতে গেছে ঘুচি
প্রকৃতির স্বহস্তে লিখা
আশীর্বাদটিকা।
উষা দিব্যদীপ্তিহারা
তোমার দিগন্তে এসে। রজনীর তারা
তোমার আকাশদুষ্ট জাতিচ্যুত, নষ্ট মন্ত্র তার,
বিক্ষুব্ধ নিদ্রার
আলোড়নে ধ্যান তার অস্বচ্ছ আবিল,
হারালো সে মিল
পূজাগন্ধী নন্দনের পারিজাত-সাথে
শান্তিহীন রাতে।

হেথা সুন্দরের কোলে
স্বর্গের বীণার সুর ভ্রষ্ট হল বলে
উদ্ধত হয়েছে ঊর্ধ্বে বীভৎসের কোলাহল,
কৃত্রিমের কারাগারে বন্দীদল
গর্বভরে
শৃঙ্খলের পূজা করে।
দ্বেষ ঈর্ষা কুৎসার কলুষে
আলোহীন অন্তরের গুহাতলে হেথা রাগে পুষে
ইতরের অহংকার-
গোপন দংশন তার;
অশ্লীল তাহার ক্লিন্ন ভাষা
সৌজন্যসংযমনাশা।
দুর্গন্ধ পঙ্কের দিয়ে দাগা
মুখোশের অন্তরালে করে শ্লাঘা;
সুরঙ্গ খনন করে,
ব্যাপি দেয় নিন্দা ক্ষতি প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে;
এই নিয়ে হাটে বাটে বাঁকা কটাক্ষের
ব্যঙ্গভঙ্গি, চতুর বাক্যের
কুটিল উল্লাস,
ক্রূর পরিহাস।

এর চেয়ে আরণ্যক তীব্র হিংসা সেও
শতগুণে শ্রেয়।
ছদ্মবেশ-অপগত
শক্তির সরল তেজে সমুদ্যত দাবাগ্নির মতো
প্রচণ্ড নির্ঘোষ;
নির্মল তাহার রোষ,
তার নির্দয়তা
বীরত্বের মাহাত্ম্যে উন্নতা।
প্রাণশক্তি তার মাঝে
অক্ষুণ্ন বিরাজে।

স্বাস্থ্যহীন বীর্যহীন যে হীনতা ধ্বংসের বাহন
গর্তখোদা ক্রিমিগণ
তারি অনুচর,
অতি ক্ষুদ্র তাই তারা অতি ভয়ংকর;
অগোচরে আনে মহামারী,
শনির কলির দত্ত সর্বনাশ তারি।

মন মোর কেঁদে আজ উঠে জাগি
প্রবল মৃত্যুর লাগি।
রুদ্র, জটাবন্ধ হতে করো মুক্ত বিরাট প্লাবন,
নীচতার ক্লেদপঙ্ক করো রক্ষা ভীষণ! পাবন!
তাণ্ডবনৃত্যের ভরে
দুর্বলের যে গ্লানিরে চূর্ণ করো যুগে যুগান্তরে,
কাপুরুষ নির্জীবের সে নির্লজ্জ অপমানগুলি
বিলুপ্ত করিয়া দিক উৎক্ষিপ্ত তোমার পদধূলি।

শান্তিনিকেতন
১৪ ভাদ্র, ১৩৪২