নির্বাক্

মনে তো ছিল তোমারে বলি কিছু
যে-কথা আমি বলি নি আর-কারে,
সেদিন বনে মাধবীশাখা নিচু
ফুলের ভারে ভারে।
বাঁশিতে লই মনের কথা তুলি
বিরহব্যথাবৃন্ত হতে ভাঙা,-
গোপন রাতে উঠেছে তারা দুলি
সুরের রঙে রাঙা।

শিরীষবন নতুনপাতা-ছাওয়া
মর্মরিয়া কহিল, “গাহো গাহো।”
মধুমালতীগন্ধে-ভরা হাওয়া
দিয়েছে উৎসাহ।
পূর্ণিমাতে জোয়ারে উছলিয়া
নদীর জল ছলছলিয়া উঠে।
কামিনী ঝরে বাতাসে বিচলিয়া
ঘাসের ‘পরে লুটে।

সে মধুরাতে আকাশে ধরাতলে
কোথাও কিছু ছিল না কৃপণতা।
চাঁদের আলো সবার হয়ে বলে
যত মনের কথা।
মনে হল যে, নীরবে কৃপা যাচে
যা-কিছু আছে তোমার চারি দিকে।
সাহস ধরি গেলেম তব কাছে
চাহিনু অনিমিখে।
সহসা মন উঠিল চমকিয়া
বাঁশিতে আর বাজিল না তো বাণী।
গহনছায়ে দাঁড়ানু থমকিয়া
হেরিনু মুখখানি।

সাগরশেষে দেখেছি একদিন
মিলিছে সেথা বহু নদীর ধারা-
ফেনিল জল দিক্সীমায় লীন
অপারে দিশাহারা।
তরণী মোর নানা স্রোতের টানে
অবোধসম কাঁপিছে থরথরি,
ভেবে না পাই কেমনে কোন্খানে
বাঁধিব মোর তরী।

তেমনি আজি তোমার মুখে চাহি
নয়ন যেন কূল না পায় খুঁজি,
অভাবনীয় ভাবেতে অবগাহি
তোমারে নাহি বুঝি।
মুখেতে তব শ্রান্ত এ কী আশা,
শান্তি এ কী, গোপন এ কী প্রীতি,
বাণীবিহীন এ কী ধ্যানের ভাষা,
এ কী সুদূর স্মৃতি;
নিবিড় হয়ে নামিল মোর মনে
স্তব্ধ তব নীরব গভীরতা-
রহিনু বসি লতাবিতান-কোণে,
কহি নি কোনো কথা।

মাঘ, ১৩৩৮