অন্ধকার

উদয়াস্ত দুই তটে অবিচ্ছিন্ন আসন তোমার,
নিগূঢ় সুন্দর অন্ধকার।
প্রভাত-আলোক-চ্ছটা শুভ্র তব আদি শঙ্খ-ধ্বনি
চিত্তের কন্দরে মোর বেজেছিলো, একদা যেমনি
নূতন চেয়েছি আঁখি তুলি’;
সে তব সঙ্কেত-মন্ত্র ধ্বনিয়াছে, হে মৌনী মহান,
কর্ম্মের তরঙ্গে মোর; স্বপ্ন-উৎস হ’তে মোর গান
উঠেছে ব্যাকুলি।।

নিস্তব্ধের সে আহ্বানে, বাহিয়া জীবন-যাত্রা মম,
-সিন্ধু-গামী তরঙ্গিণী সম-
এতকাল চ’লেছিনু তোমারি সুদূর অভিসারে
বঙ্কিম জটিল পথে সুখে দুঃখে বন্ধুর সংসারে
অনির্দ্দেশ অলক্ষ্যের পানে।
কভু পথতরু-চ্ছায়ে খেলাঘর ক’রেছি রচনা,
শেষ না হইতে খেলা চলিয়া এসেছি অন্যমনা
অশেষের টানে।।

আজি মোর ক্লান্তি ঘেরি’ দিবসের অন্তিম প্রহর
গোধূলির ছায়ায় ধূসর।
হে গম্ভীর, আসিয়াছি তোমার সোনার সিংহদ্বারে
যেখানে দিনান্ত-রবি আপন চরম নমস্কারে
তোমার চরণে নত হ’লো।
যেথা রিক্ত নিঃস্ব দিবা প্রাচীন ভিক্ষুর জীর্ণবেশে
নূতন প্রাণের লাগি’ তোমার প্রাঙ্গণ-তলে এসে
বলে “দ্বার খোলো”।।

দিনের আড়ালে থেকে কি চেয়েছি পাইনি উদ্দেশ,
আজ সে সন্ধান হোক শেষ।
হে চির-নির্ম্মল, তব শান্তি দিয়ে স্পর্শ করো চোখ,
দৃষ্টির সম্মুখে মম এইবার নির্ব্বারিত হোক
আঁধারের আলোক ভাণ্ডার।
নিয়ে যাও সেই-খানে নিঃশব্দের গূঢ় গুহা হ’তে
যেখানে বিশ্বের কণ্ঠে নিঃসরিছে চিরন্তন স্রোতে
সঙ্গীত তোমার।।

দিনের সংগ্রহ হ’তে আজি কোন অর্ঘ্য নিয়ে যাই
তোমার মন্দিরে ভাবি তাই।
কত না শ্রেষ্ঠির হাতে পেয়েছি কীর্ত্তির পুরস্কার,
সযত্নে এসেছি বহে সেই-সব রত্ন অলঙ্কার,
ফিরিয়াছি দেশ হ’তে দেশে।
শেষে আজ চেয়ে দেখি, যবে মোর যাত্রা হ’লো সারা,
দিনের আলোর সাথে ম্লান হয়ে এসেছে তাহারা
তব দ্বারে এসে।।

রাত্রির নিকষে হায় কত সোনা হ’য়ে যায় মিছে,
সে বোঝা ফেলিয়া যাবে পিছে।
কিছু বাকি আছে তবু, প্রাতে মোর যাত্রা সহচরী
অকারণে দিয়েছিলো মোর হাতে মাধবী-মঞ্জরী,
আজো তাহা অম্লান বিরাজে।
শিশিরের ছোঁয়া যেন এখনো র’য়েছে তা’র গায়,
এ জন্মের সেই দান রেখে দেবো তোমার থালায়
নক্ষত্রের মাঝে।।

হে নিত্য নবীন, কবে তোমারি গোপন কক্ষ হ’তে
পাড়ি দিলো এ ফুল আলোতে।
সুপ্তি হ’তে জেগে দেখি, বসন্তে একদা রাত্রি-শেষে
অরুণ কিরণ সাথে এ মাধুরী আসিয়াছে ভেসে
হৃদয়ের বিজন পুলিনে।
দিবসের ধূলা এরে কিছুতে পারেনি কাড়িবারে,
সেই তব নিজ দান বহিয়া আনিনু তব দ্বারে,
তুমি লও চিনে।।

হে চরম, এরি গন্ধে তোমারি আনন্দ এলো মিশে,
বুঝেও তখন বুঝিনি সে।
তব লিপি বর্ণে বর্ণে লেখা ছিলো এরি পাতে পাতে,
তাই নিয়ে গোপনে সে এসেছিলো তোমারে চিনাতে,
কিছু যেন জেনেছি আভাসে।
আজিকে সন্ধ্যায় যবে সব শব্দ হ’লো অবসান
আমার ধেয়ান হ’তে জাগিয়া উঠিছে এরি গান
তোমার আকাশে।।

জুলিয়ো চেজারে জাহাজ,
১০ জানুয়ারি, ১৯২৫।