অনন্ত মরণ

কোটি কোট ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে
বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,
হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।
এ ধরণী মরণের পথ,
এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।

যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?
সে তো শুধু পলক, নিমেষ।
অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,
না জানি কোথায় তার শেষ।
যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ ম’রে গেছি,
মরিতেছি প্রতি পলে পলে,
জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি
জানি নে মরণ কারে বলে।

এক মুঠা মরণেরে জীবন ব’লে কি তবে,
মরণের সমষ্টি কেবল?
একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,
নাম নিয়ে এত কোলাহল।
মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,
পলে পলে উঠিব আকাশে
নক্ষত্রের কিরণ নিবাসে।

ভাবিতেছি কল্পনায়, কত কাল গেছে চলে,
বয়ক্রম সহস্র বরষ,
মরণের স্তরে স্তরে অতি দীর্ঘ-দীর্ঘ প্রাণ,
কোন্‌ শূন্য করেছে পরশ।
হয়তো গিয়েছি আমি কত শত গ্রহ ছুঁয়ে
বৃহস্পতি গ্রহের মাঝারে,
জীবনের একপ্রান্ত রয়েছে পৃথিবী মাঝে
শেষ প্রান্ত বৃহস্পতি পারে।
শুধু দেখিতেছি চেয়ে সুদীর্ঘ জীবন ক্ষেত্রে,
অতীতের দিগন্তের পানে,
অতি ক্ষীণ দেখা যায় পৃথিবী জ্যোতির কণা
জড়িত রয়েছে সেইখানে।
তারি পানে কতক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া শেষে-
হয়তো সহসা কী কারণে,
আজিকার যে মুহুর্তে এত কথা ভাবিতেছি
এ মুহুর্তে পড়িবে স্মরণে।
পৃথিবীর কত খেলা পৃথিবীর কত কথা,
পরানেতে বেড়াইবে ভেসে,
পৃথিবীর সহচর না জানি কোথায় তা’রা
গেছে কোন্‌ তারকার দেশে।
হয়তো পড়িবে মনে, পৃথিবীর প্রান্তে বসি
গেয়েছিনু যে কয়টি গান,
সে গানের বিম্বগুলি হয়তো এখনো ভাসে
ধরার স্রোতের মাঝখান।

সহস্র বরষ পরে, সেই গ্রহ মাঝে বসি,
না জানি গাহিব সে কী গান।
কী অনন্ত মন্দাকীনি না জানি ছুটিবে, যবে
খুলে যাবে সে বিশাল-প্রাণ।
মরণের সংগীত মহান।
হয়তো বা সে নিশীথে কবি এক পৃথিবীতে
চেয়ে আছে মোর গ্রহ পানে;
কী মহা সংগীত ধারা গ্রহ হতে গ্রহে ঝরি
পশিবেক তাহার পরানে।
বিস্ফোরিত করি’ আঁখি শিহরিত কলেরবে
শুনিবে সে আধো-শোনা গান,
কত কী উঠিবে মনে ব্যক্ত করিবার তরে
আকুল ব্যাকুল হবে প্রাণ।
আপনার কথা শুনে আপনি বিস্মিত হবে,
চাহিয়া রহিবে অবিরত
নিদ্রাহীন স্বপ্নটির মতো।
নয়নে পড়িবে অশ্রুজল,
বুঝিবে না, শুনিবে কেবল।

মরণ বাড়িবে যত কোথায় কোথায় যাব,
বাড়িবে প্রাণের অধিকার,
বিশাল প্রাণের মাঝে কত গ্রহ কত তারা
হেথা হোথা করিবে বিহার।
উঠিবে জীবন মোর কত-না আকাশ ছেয়ে,
ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী,
যুগ-যুগান্তর যাবে, নব নব রাজ্য পাবে
নব নব তারায় প্রবেশি।

কবে রে আসিবে সেই দিন
উঠিব সে আকাশের পথে,
আমার মরণ-ডোর দিয়ে
বেঁধে দেব জগতে জগতে।
আমার মরণ ডোর দিয়ে
গেঁথে দেব জগতের মালা,
রবি শশী একেকটি ফুল,
চরাচর কুসুমের ডালা।
তোরাও আসিবি ভাই, উঠিবি রে দশ দিকে,
এক সাথে হইবে মিলন,
ডোরে ডোরে লাগিবে বাঁধন।
আমাদের মরণের জালে
জগৎ ফেলিব আবরিয়া,
এ অনন্ত আকাশসাগরে
দশ দিক রহিব ঘেরিয়া।
পড়িবে তপন তায়, চন্দ্রমা জড়ায়ে যাবে,
পড়িবেক কোটি কোটি তারা
পৃথ্বী কোথা হয়ে যাবে হারা।
আয় ভাই সব যাই ভুলি,
সকলে করিবে কোলাকুলি।
সে কিরে আনন্দ মহোৎসব,
গগতেরে ফেলিব ঘেরিয়া,
আমাদের মরণের মাঝে
চরাচর বেড়াবে ঘুরিয়া।

জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক
আমাদের অনন্ত মরণ,
মরণের হবে না মরণ।
এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু
লইলাম তোমার শরণ,
এসো তুমি এসো কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি,
পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,
আমাদের করো হে পালন।
বাড়িব তোমার স্নেহে, নব বল পাব দেহে,
ডাকিব হে জননী বলিয়া,
তোমার অঞ্চল ধরি জগতের খেলা ঘরে,
অবিরাম বেড়াব খেলিয়া।
হেথা নাবি হোথা উঠি করিব রে ছুটাছুটি,
বেড়াইব তারায় তারায়,
সুকুমার বিদ্যুতের প্রায়।
আনন্দে পুরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে
মরণের অনন্ত উৎসব,
কার নিমন্ত্রণে মোরা, মহাযজ্ঞে এসেছি রে,
উঠেছে বিপুল কলরব।
যে ডাকিছে ভালোবেসে, তারে চিনিস নে শিশু?
তার কাছে কেন তোর ডর?
জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,
মরণ তো নহে তোর পর।
আয়, তারে অলিঙ্গন কর্,
আয়, তার হাতখানি ধর্।