অন্তর্হিতা

প্রদীপ যখন নিবেছিলো,
আঁধার যখন রাতি,
দুয়ার যখন বন্ধ ছিলো,
ছিলো না কেউ সাথী।
মনে হ’লো অন্ধকারে
কে এসেছে বাহির দ্বারে,
মনে হ’লো শুনি যেন
পায়ের ধ্বনি কার,
রাতের হাওয়ায় বাজ্লো বুঝি
কঙ্কণ-ঝঙ্কার।।

বারেক শুধু মনে হ’লো
খুলি, দুয়ার খুলি।
ক্ষণেক পরে ঘুমের ঘোরে
কখন গেনু ভুলি’।
“কোন্ অতিথি দ্বারের কাছে
এক্লা রাতে ব’সে আছে?”
ক্ষণে ক্ষণে তন্দ্রা ভেঙে
মন শুধালো যবে,
ব’লেছিলেম আর কিছু নয়,
স্বপ্ন আমার হবে।।

মাঝ-গগনে সপ্ত-ঋষি
স্তব্ধ গভীর রাতে
জান্লা হ’তে আমায় যেন
ডাক্লো ইসারাতে।
মনে হ’লো, শয়ন ফেলে
দিই না কেন আলো জ্বেলে,
আলসভরে রইনু শুয়ে
হ’লো না দীপ জ্বালা।
প্রহর পরে কাট্লো প্রহর,
বন্ধ রইলো তালা।।

জাগ্লো কখন দখিন হাওয়া
কাঁপ্লো বনের হিয়া,
স্বপ্নে কথা-কওয়ার মতো
উঠ্লো মর্ম্মরিয়া।
যূথীর গন্ধ ক্ষণে ক্ষণে
মূর্চ্ছিল মোর বাতায়নে,
শিহর দিয়ে গেলো, আমার
সকল অঙ্গ চুমে।
জেগে উঠে আবার কখন্
ভ’র্লো নয়ন ঘুমে।।

ভোরের তারা পূব-গগনে
যখন হ’লো গত
বিদায় রাতির একটি ফোঁটা
চোখের জলের মতো,
হঠাৎ মনে হ’লো তবে,
যেন কাহার করুণ-রবে
শিরীষ ফুলের গন্ধে আকুল
বনের বীথি ব্যেপে
শিশির-ভেজা তৃণগুলি
উঠ্লো কেঁপে কেঁপে।।

শয়ন ছেড়ে উঠে তখন
খুলে দিলেম দ্বার,
হায় রে, ধূলায় বিছিয়ে গেছে
যুথীর মালা কার।
ঐ যে দূরে, নয়ন নত
বনের ছায়ায় ছায়ার মতো
মায়ার মতো মিলিয়ে গেলো
অরুণ আলোয় মিশে,
ঐ বুঝি মোর বাহির দ্বারের
রাতের অতিথি সে।।

আজ হ’তে মোর ঘরের দুয়ার
রাখ্বো, খুলে রাতে।
প্রদীপখানি র’ইবে জ্বালা
বাহির জানালাতে।
আজ হ’তে কার পরশ লাগি’
পথ তাকিয়ে র’ইবো জাগি’;
আর কোনোদিন আস্বে না কি
আমার পরাণ ছেয়ে
যুথীর মালার গন্ধখানি
রাতের বাতাস বেয়ে?

বুয়েনোস্ এয়ারিস্,
১৬ নভেম্বর, ১৯২৪।