পঁচিশে বৈশাখ

রাত্রি হ’লো ভোর।
আজি মোর
জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,
প্রভাতের রৌদ্রে লেখা লিপিখানি
হাতে ক’রে আনি’,
দ্বারে আসি দিল’ ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।

দিগন্তে আরক্ত রবি;
অরণ্যের ম্লান ছায়া বাজে যেন বিষন্ন ভৈরবী
শাল তাল শিরীষের মিলিত মর্ম্মরে
বনান্তের ধ্যান ভঙ্গ করে।
রক্তপথ শুষ্ক মাঠে,
যেন তিলকের রেখা সন্ন্যাসীর উদার ললাটে।

এই দিন বৎসরে বৎসরে
নানা বেশে আসে ধরণীর পরে,-
আতাম্র আম্রের বনে ক্ষণে ক্ষণে সাড়া দিয়ে,
তরুণ তালের গুচ্ছে নাড়া দিয়ে,
মধ্যদিনে অকস্মাৎ শুষ্কপত্রে তাড়া দিয়ে,
কখনো বা আপনারে ছাড়া দিয়ে
কাল-বৈশাখীর মত্ত মেঘে
বন্ধহীন বেগে।
আর সে একান্তে আসে
মোর পাশে
পীত উত্তরীয়-তলে ল’য়ে মোর প্রাণ-দেবতার
স্বহস্তে সজ্জিত উপহার-
নীলকান্ত আকাশের থালা,
তা’রি পরে ভুবনের উচ্ছলিত সুধার পেয়ালা।

এই দিন এলো আজ প্রাতে
যে অনন্ত সমুদ্রের শঙ্খ নিয়ে হাতে,
তাহার নির্ঘোষ বাজে
ঘন ঘন মোর বক্ষ-মাঝে।
জন্ম-মরণের
দিগ্বলয়-চক্ররেখা জীবনেরে দিয়েছিল ঘের,
সে আজি মিলালো।
শুভ্র আলো
কালের বাঁশরী হ’তে উচ্ছসি যেন রে
শূন্য দিল’ ভ’রে।
আলোকের অসীম সঙ্গীতে
চিত্ত মোর ঝঙ্কারিছে সুরে সুরে রণিত তন্ত্রীতে।

উদয়-দিক্প্রান্ত-তলে নেমে এসে
শান্ত হেসে
এই দিন বলে আজি মোর কানে,
“অম্লান নূতন হয়ে অসংখ্যের মাঝখানে
একদিন তুমি এসেছিলে
এ নিখিলে
নব মল্লিকার গন্ধে,
সপ্তপর্ণ-পল্লবের পবন-হিল্লোল-দোল-ছন্দে,
শ্যামলের বুকে,
নির্নিমেষ নীলিমার নয়ন-সম্মুখে।
সেই যে নূতন তুমি,
তোমারে ললাট চুমি’
এসেছি জাগাতে
বৈশাখের উদ্দীপ্ত প্রভাতে।

হে নূতন,
দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
আচ্ছন্ন করেছে তা’রে আজি
শীর্ণ নিমেষের যত ধূলিকীর্ণ জীর্ণ পত্ররাজি।
মনে রেখো, হে নবীন,
তোমার প্রথম জন্মদিন
ক্ষয়হীন;-
যেমন প্রথম জন্ম নির্ঝরের প্রতি পলে পলে;
তরঙ্গে তরঙ্গে সিন্ধু যেমন উছলে
প্রতিক্ষণে
প্রথম জীবনে।
হে নূতন,
হোক তব জাগরণ
ভস্ম হ’তে দীপ্ত হুতাশন।
হে নূতন,
তোমার প্রকাশ হোক কুজ্ঝটিকা করি’ উদ্ঘাটন
সূর্য্যের মতন।
বসন্তের জয়ধ্বজা ধরি’,
শূন্য শাখে কিশলয় মুহূর্ত্তে অরণ্য দেয় ভরি’-
সেই মতো, হে নূতন,
রিক্ততার বক্ষ ভেদি’ আপনারে করো উন্মোচন।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক, তোমা মাঝে অনন্তের অক্লান্ত বিস্ময়।”

উদয়-দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে।
মোর চিত্ত-মাঝে
চির-নূতনেরে দিল’ ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।

(২৫ বৈশাখ, ১৩২৯)