পতিতা

ধন্য তোমারে হে রাজমন্ত্রী,
চরণপদ্মে নমস্কার।
লও ফিরে তব স্বর্ণমুদ্রা,
লও ফিরে তব পুরস্কার।
ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিরে ভুলাতে
পাঠাইলে বনে যে কয়জনা
সাজায়ে যতনে ভূষণে রতনে,-
আমি তারি এক বারাঙ্গনা।
দেবতা ঘুমালে আমাদের দিন,
দেবতা জাগিলে মোদের রাতি,
ধরার নরক-সিংহদুয়ারে।
জ্বালাই আমরা সন্ধ্যাবাতি।
তুমি অমাত্য রাজসভাসদ
তোমার ব্যবসা ঘৃণ্যতর, সিংহাসনের আড়ালে বসিয়া
মানুষের ফাঁদে মানুষ ধর। আমি কি তোমার গুপ্ত অস্ত্র,
হৃদয় বলিয়া কিছু কি নেই?
ছেড়েছি ধরম, তা ব’লে ধরম
ছেড়েছে কি মোরে একেবারেই?
নাহিক করম, লজ্জা সরম,
জানিনে জনমে সতীর প্রথা,
তা বলে’ নারীর নারীত্বটুকু
ভুলে যাওয়া সে কি কথার কথা?

সে যে তপোবন, স্বচ্ছ পবন,
অদূরে সুনীল শৈলমালা,
কলগান করে পুণ্য তটিনী,
সে কি নগরীর নাট্যশালা?
মনে হ’ল সেথা অন্তর-গ্লানি
বুকের বাহিরে বাহিরি’ আসে।-
ওগো বনভূমি মোরে ঢাক তুমি
নবনিৰ্ম্মল শ্যামল বাসে।
অয়ি উজ্জ্বল উদার আকাশ
লজ্জিত জনে করুণা করে’
তোমার সহজ অমলতাখানি
শতপাকে ঘেরি পরাও মোরে।

স্থান আমাদের রুদ্ধ নিলয়ে
প্রদীপের পীত আলোক জ্বালা’,
যেথায় ব্যাকুল বদ্ধ বাতাস
ফেলে নিশ্বাস হুতাশ-ঢালা।
রতন নিকরে কিরণ ঠিকরে,
মুকুতা ঝলকে অলকপাশে,
মদির-শীকর-সিক্ত আকাশ
ঘন হ’য়ে যেন ঘেরিয়া আসে।
মোরা গাঁথা মালা প্রমোদ-রাতের,
গেলে প্রভাতের পুষ্পবনে
লাজে ম্লান হয়ে মরে’ ঝরে’ যাই,
মিশাবারে চাই মাটির সনে।
তবু তবু ওগো কুসুম-ভগিনী
এবার বুঝিতে পেরেছি মনে
ছিল ঢাকা সেই বনের গন্ধ
অগোচরে কোন্ প্রাণের কোণে।

সেদিন নদীর নিকষে অরুণ
আঁকিল প্রথম সোনার লেখা;
স্নানের লাগিয়া তরুণ তাপস
নদীতীরে ধীরে দিলেন দেখা।
পিঙ্গল জটা ঝলিছে ললাটে
পূর্ব অচলে ঊষার মত,
তনু দেহখানি জ্যোতির লতিকা
জড়িত স্নিগ্ধ তড়িৎ শত।
মনে হ’ল মোর নব-জনমের
উদয়শৈল উজল করি’
শিশির-ধৌত পরম প্রভাত
উদিল নবীন জীবন ভরি’।
তরুণীরা মিলি তরণী বাহিয়া
পঞ্চমসুরে ধরিল গান,
ঋষির কুমার মোহিত চকিত
মৃগশিশুসম পাতিল কান।
সহসা সকলে ঝাঁপ দিয়া জলে
মুনি-বালকেরে ফেলিয়া ফাঁদে
ভুজে ভুজে বাঁধি ঘিরিয়া ঘিরিয়া
নৃত্য করিল বিবিধ ছাঁদে।
নূপুরে নূপুরে দ্রুত তালে তালে
নদীজলতলে বাজিল শিলা,
ভগবান ভানু-রক্ত-নয়নে
হেরিলা নিলাজ নিঠুর লীলা।

প্রথমে চকিত দেবশিশু সম
চাহিলা কুমার কৌতুহলে,-
কোথা হ’তে যেন অজানা আলোক
পড়িল তাহার পথের তলে।
দেখিতে দেখিতে ভক্তি-কিরণ
দীপ্তি সঁপিল শুভ্র ভালে,-
দেবতার কোন্‌ নূতন প্রকাশ
হেরিলেন আজি প্রভাতকালে।
বিমল বিশাল বিস্মিত চোখে
দুটি শুকতারা উঠিল ফুটি’,
বন্দনা-গান রচিলা কুমার
জোড় করি কর-কমল দুটি।
করুণ কিশোর কোকিল কণ্ঠে
সুধার উৎস পড়িল টুটে,
স্থির তপোবন শান্তি মগন
পাতায় পাতায় শিহরি উঠে।
যে গাথা গাহিলা সে কখনো আর
হয় নি রচিত নারীর তরে,
সে শুধু শুনেছে নিৰ্মলা ঊষা
নির্জ্জন গিরিশিখর পরে।
সে শুধু শুনেছে নীরব সন্ধ্যা
নীল নির্বাক্‌ সিন্ধুতলে
শুনে গলে’ যায় আর্দ্র হৃদয়
শিশির শীতল অশ্রুজলে।
হাসিয়া উঠিল পিশাচীর দল
অঞ্চলতল অধরে চাপি।
ঈষৎ ত্রাসের তড়িৎ-চমক
ঋষির নয়নে উঠিল কাঁপি।
ব্যথিত চিত্তে ত্বরিত চরণে
করজোড়ে পাশে দাঁড়ানু আসি,
কহিনু,- হে মোর প্রভু তপোধন
চরণে আগত অধম দাসী।
তীরে ল’য়ে তারে, সিক্ত অঙ্গ
মুছানু আপন পট্টবাসে।
জানু পাতি বসি যুগল চরণ
মুছিয়া লইনু এ কেশপাশে।
তা’র পরে মুখ তুলিয়া চাহিনু
উৰ্দ্ধমুখীন্‌ ফুলের মত,-
তাপস কুমার চাহিলা, আমার
মুখপানে করি বদন নত।
প্রথম-রমণী-দরশ-মুগ্ধ
সে দুটি সরল নয়ন হেরি
হৃদয়ে আমার নারীর মহিমা
বাজায়ে উঠিল বিজয়-ভেরী।
ধন্য রে আমি, ধন্য বিধাতা
সূজেছ আমারে রমণী করি।
তার দেহময় উঠে মোর জয়,
উঠে জয় তাঁর নয়ন ভরি।
জননীর স্নেহ রমণীর দয়া
কুমারীর নব নীরব প্রীতি
আমার হৃদয় বীণার-তন্ত্রে
বাজায়ে তুলিল মিলিত গীতি।

কহিলা কুমার চাহি মোর মুখে-
কোন্ দেব আজি আনিলে দিবা?
তোমার পরশ অমৃত-সরস,
তোমার নয়নে দিব্য বিভা।
হেসো না মন্ত্রী হেসসা না হেসো না,
ব্যথায় বিঁধো না ছুরির ধার
ধূলিলুণ্ঠিতা অবমানিরে
অবমান তুমি কোরো না আর।
মধুরাতে কত মুগ্ধহৃদয়
স্বর্গ মেনেছে এ দেহখানি,-
তখন শুনেছি বহু চাটুকথা,
শুনিনি এমন সত্যবাণী।
সত্য কথা এ, কহিনু আবার,
স্পর্ধা আমার কভু এ নহে,-
ঋষির নয়ন মিথ্যা হেরে না,
ঋষির রসনা মিছে না কহে।
বৃদ্ধ, বিষয়-বিষ-জর্জ্জর,
হেরিছ বিশ্ব দ্বিধার ভাবে,
নগরীর ধূলি লেগেছে নয়নে,
আমারে কি তুমি দেখিতে পাবে?
আমিও দেবতা, ঋষির আঁখিতে
এনেছি বহিয়া নূতন দিবা,
অমৃত-সরস আমার পরশ,
আমার নয়নে দিব্য বিভা।
আমি শুধু নহি সেবার রমণী
মিটাতে তোমার লালসাক্ষুধা।
তুমি যদি দিতে পূজার অর্ঘ্য।
আমি সঁপিতাম স্বর্গসুধা।
দেবতারে মোর কেহ ত চাহেনি,
নিয়ে গেল সবে মাটির ঢেলা,
দূর দুর্গম মনোবনবাসে
পাঠাইল তাঁরে করিয়া হেলা।
সেইখানে এল আমার তাপস,
সেই পথহীন বিজন গেহ,-
স্তব্ধ নীরব গহন গভীর
যেথা কোনোদিন আসেনি কেহ।
সাধকবিহীন একক দেবতা
ঘুমাতেছিলেন সাগরকূলে,-
ঋষির বালক পুলকে তাঁহারে
পূজিলা প্রথম পূজার ফুলে।
আনন্দে মোর দেবতা জাগিল,
জাগে আনন্দ ভকত-প্রাণে,-
এ বারতা মোর দেবতা তাপস
দোঁহে ছাড়া আর কেহ না জানে।

কহিলা কুমার চাহি মোর মুখে
আনন্দময়ী মূরতি তুমি,
ফুটে আনন্দ বাহুতে তোমার,
ছুটে আনন্দ চরণ চুমি’।-
শুনি সে বচন, হেরি সে নয়ন,
দুই চোখে মোর ঝরিল বারি।
নিমেষে ধৌত নিৰ্ম্মল রূপে
বাহিরিয়া এল কুমারী নারী।
বহুদিন মোর প্রমোদ-নিশীথে
যত শত দীপ জ্বলিয়াছিল
দূর হতে দূরে,- এক নিশ্বাসে
কে যেন সকলি নিয়ে দিল।
প্রভাত-অরুণ-ভা’য়ের মতন
সঁপি দিল কর আমার কেশে
আপনার করি নিল পলকেই
মোরে তপোবন-পবন এসে।
মিথ্যা তোমার জটিল বুদ্ধি,
বৃদ্ধ তোমার হাসিরে ধিক্!
চিত্ত তাহার আপনার কথা
আপন মৰ্ম্মে ফিরায়ে নিক্‌।
তোমার পামরী পাপিনীর দল
তারাও অমনি হাসিল হাসি,-
আবেশে বিলাসে ছলনার পাশে
চারিদিক্‌ হ’তে ঘেরিল আসি।
বসনাঞ্চল লুটায় ভূতলে,
বেণী খসি পড়ে কবরী টুটি’
ফুল ছুঁড়ে ছুড়ে মারিল কুমারে
লীলায়িত করি হস্ত দুটি।
হে মোর অমল কিশোর তাপস
কোথায় তোমারে আড়ালে রাখি
আমার কাতর অন্তর দিয়ে
ঢাকিবারে চাই তোমার আঁখি।
হে মোর প্রভাত, তোমারে ঘেরিয়া
পারিতাম যদি, দিতাম টানি
ঊষার রক্ত মেঘের মতন
আমার দীপ্ত সরমখানি।
ও আহুতি তুমি নিয়ো না নিয়ে না
হে মোর অনল, তপের নিধি,
আমি হয়ে ছাই তোমারে লুকাই
এমন ক্ষমতা দিল না বিধি।
ধিক্ রমণীরে ধিক্‌ শতবার,
হতলাজ বিধি তোমারে ধিক্।
রমণীজাতির ধিক্কার গানে
ধ্বনিয়া উঠিল সকল দিক্‌।
ব্যাকুল সরমে অসহ ব্যথায়
লুটায়ে ছিন্নালতিকাসমা
কহিনু তাপসে- পুণ্যচরিত,
পাতকিনীদের করিয়ো ক্ষমা।
আমারে মিয়া, আমারে ক্ষমিয়ো,
আমারে ক্ষমিয়ো করুণানিধি।-
হরিণীর মত ছুটে চলে’ এনু
সরমের শর মৰ্ম্মে বিঁধি।
কঁদিয়া কহিনু কাতরকণ্ঠে
আমারে মিয়ো পুণ্যরাশি।-
চপলভঙ্গে লুটায়ে রঙ্গে
পিশাচীরা পিছে উঠিল হাসি।
ফেলি দিল ফুল মাথায় আমার
তপোবন-তরু করুণা মানি,
দূর হ’তে কানে বাজিতে লাগিল
বাঁশির মতন মধুর বাণী,-
আনন্দময়ী মূরতি তোমার,
কোন্ দেব তুমি আনিলে দিবা?
অমৃতসরস তোমার পরশ,
তোমার নয়নে দিব্য বিভা।-
দেবতারে তুমি দেখেছ, তোমার
সরল নয়ন করেনি ভুল।
দাও মোর মাথে, নিয়ে যাই সাথে
তোমার হাতের পূজার ফুল।
তোমার পূজার গন্ধ আমার
মনোমন্দির ভরিয়া র’বে-
সেথায় দুয়ার রুধিমু এবার,
যতদিন বেঁচে রহিব ভবে।

মন্ত্রী, আবার সেই বাঁকা হাসি?
না হয় দেবতা আমাতে নাই-
মাটি দিয়ে তবু গড়ে ত প্রতিমা,
সাধকেরা পূজা করে ত তাই।
একদিন তা’র পূজা হ’য়ে গেলে
চিরদিন তা’র বিসর্জ্জন,
খেলার পুতলি করিয়া তাহারে
আর কি খেলিবে পৌরজন?
পূজা যদি মোর হয়ে থাকে শেষ
হয়ে গেছে শেষ আমার খেলা।
দেবতার লীলা করি সমাপন
জলে ঝাঁপ দিবে মাটির ঢেলা।
হাস হাস তুমি হে রাজমন্ত্রী
ল’য়ে আপনার অহঙ্কার-
ফিরে লও তব স্বর্ণমুদ্রা
ফিরে লও তব পুরস্কার।
বহু কথা বৃথা বলেছি তোমায়
তা লাগি হৃদয় ব্যথিছে মোরে।
অধম নারীর একটি বচন
রেখো হে প্রাজ্ঞ স্মরণ করে,
বুদ্ধির বলে সকলি বুঝেছ,
দুয়েকটি বাকি রয়েছে তবু,
দৈবে যাহারে সহসা বুঝায়
সে ছাড়া সে কেহ বোঝে না কভু।

৯ই কার্তিক, ১৩০৪