সন্ধ্যা

ক্ষান্ত হও, ধীরে কও কথা! ওরে মন,
নত কর শির! দিবা হল সমাপন,
সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী। তিমিরের তীরে
অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা’ এ বিশ্বমন্দিরে
এল আরতির বেলা। ওই শুন বাজে
নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে
শখঘণ্টাধ্বনি। ধীরে নামাইয়া আন’
বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পুরবীর ম্লান-
মন্দ স্বরে। রাখ রাখ অভিযোগ তব,-
মৌন কর বাসনার নিত্য নব নব
নিস্ফল বিলাপ! হের, মৌন নভস্তল,
ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন, মৌন জলস্থল
স্তম্ভিত বিষাদে নম্র! নির্ব্বাক্ নীরব
দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী-নয়ন পল্পব
নত হয়ে ঢাকে তার নয়ন যুগল,-
অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু ছলছল
করিয়া গোপন। বিষাদের মহাশান্তি
ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তে
সান্ত্বনা পরশ। আজি এই শুভক্ষণে,
শান্ত মনে, সন্ধি কর অনন্তের সনে
সন্ধ্যার আলোকে! বিন্দু দুই অশ্রুজলে
দাও উপহার- অসীমের পদতলে
জীবনের স্মৃতি! অন্তরের যত কথা
শান্ত হয়ে গিয়ে- মর্ম্মান্তিক নীরবতা
করুক্ বিস্তার।

হের ক্ষুদ্র নদীতীরে
সুপ্তপ্রায় গ্রাম। পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে,
শিশুরা খেলে না; শূন্য মাঠ জনহীন;
ঘরে ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই তিন
কুটীর অঙ্গনে বাঁধা, ছবির মতন
স্তব্ধপ্রায়। গৃহকার্য্য হল সমাপন,-
কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি
সম্মুখে দেখিছে চাহি, ভাবিছে কি জানি
ধূসর সন্ধ্যায়।

অমনি নিস্তব্ধ প্রাণে
বসুন্ধরা, দিবসের কর্ম্ম অবসানে,
দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া, আছে চাহি
দিগন্তের পানে; ধীরে যেতেছে প্রবাহি
সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত-অম্বরে
নিঃশব্দ চরণে; আকাশের দূরান্তরে
একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির
একেকটি দীপ্ততারা, সুদূর পল্লীর
প্রদীপের মত! ধীরে যেন উঠে ভেসে
ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ন-নিমেষে
কত যুগযুগান্তের অতীত আভাস,
কত জীব-জীবনের জীর্ণ ইতিহাস।
যেন মনে পড়ে সেই বাল্য নীহারিকা,
তার পরে প্রজ্জলন্ত যৌবনের শিখা,
তার পরে স্নিগ্ধতাম অন্নপূর্ণালয়ে
জীবধাত্রী জননীর কাজ, বক্ষে লয়ে
লক্ষ কোটি জীব- কত দুঃখ, কত ক্লেশ,
কত যুদ্ধ, কত মৃত্যু, নাহি তার শেষ!

ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার,
গাঢ়তর নীরবতা,- বিশ্ব-পরিবার
সুপ্ত নিশ্চেতন। নিঃসঙ্গিনী ধরণীর
বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর
একটি ব্যথিত প্রশ্ন- ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর
শূন্যপানে- “আরো কোথা?” “আরো কত দূর?”

৯ ফাল্গুন,
১৩০০ সাল।