সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে

সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে
অস্ত-সমুদ্রে সদ্য স্নান ক’রে।
মনে হোলো, স্বপ্নের ধূপ উঠছে
নক্ষত্রলোকের দিকে।
মায়াবিষ্ট নিবিড় সেই স্তব্ধ ক্ষণে-
-তার নাম করব না-
সবে সে চুল বেঁধেছে, পরেছে আসমানি রঙের শাড়ি,
খোলা ছাদে গান গাইছে একা।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলেম পিছনে
ও হয়তো জানে না, কিংবা হয়তো জানে।।

ওর গানে বলছে সিন্ধু কাফির সুরে-

-চলে যাবি এই যদি তোর মনে থাকে
ডাকব না ফিরে ডাকব না,
ডাকি নে তো সকালবেলার শুকতারাকে।-

শুনতে শুনতে স’রে গেল সংসারের ব্যাবহারিক আচ্ছাদনটা,
যেন কুঁড়ি থেকে পূর্ণ হয়ে ফুটে বেরােল
অগোচরের অপরূপ প্রকাশ;
তার লঘু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল আকাশে;
অপ্রাপণীয়ের সে দীর্ঘনিঃশ্বাস,
দুরূহ দুরাশার সে অনুচ্চারিত ভাষা।

একদা মৃত্যুশোকের বেদমন্ত্র
তুলে ধরেছে বিশ্বের আবরণ, বলেছে-
পৃথিবীর ধূলি মধুময়।
সেই সুরে আমার মন বললে,-
সংগীতময় ধরার ধূলি।
আমার মন বললে,-
মৃত্যু, ওগো মধুময় মৃত্যু,
তুমি আমায় নিয়ে চলেছ লোকান্তরে
গানের পাখায়।।

আমি ওকে দেখলেম-
যেন নিকষবরন ঘাটে সন্ধ্যার কালো জলে
অরুণবরন পা-দুখানি ডুবিয়ে বসে আছে অপ্সরী,
অকূল সরোবরে সুরের ঢেউ উঠেছে মৃদুমৃদু,
আমার বুকের কাঁপনে কাঁপন-লাগা হাওয়া
ওকে স্পর্শ করছে ঘিরে ঘিরে।।

আমি ওকে দেখলেম,
যেন আলো-নেবা বাসরঘরে নববধূ,
আসন্ন প্রত্যাশার নিবিড়তায়
দেহের সমস্ত শিরা স্পন্দিত।
আকাশে ধ্রুবতারার অনিমেষ দৃষ্টি,
বাতাসে সাহানা রাগিণীর করুণা।।

আমি ওকে দেখলেম
ও যেন ফিরে গিয়েছে পূর্বজন্মে
চেনা অচেনার অস্পষ্টতায়।
সে যুগের পালানো বাণী ধরবে ব’লে
ঘুরিয়ে ফেলছে গানের জাল,
সুরের ছোঁয়া দিয়ে খুঁজে খুঁজে ফিরছে
হারানো পরিচয়কে।।

সমুখে ছাদ ছাড়িয়ে উঠেছে বাদাম গাছের মাথা,
উপরে উঠল কৃষ্ণচতুর্থীর চাঁদ।
ডাকলেম নাম ধ’রে।
তীক্ষ্ণ বেগে উঠে দাঁড়াল সে,
ভ্রূকুটি ক’রে বললে, আমার দিকে ফিরে,-
“এ কী অন্যায়
কেন এলে লুকিয়ে।”
কোনো উত্তর করলেম না।
বললেম না, প্রয়োজন ছিল না এই তুচ্ছ ছলনার
বললেম না, আজ সহজে বলতে পারতে, এসো,
বলতে পারতে,-খুশি হয়েছি।
মধুময়ের উপর পড়ল ধুলার আবরণ।।

পরদিন ছিল হাটবার।
জানলায় ব’সে দেখছি চেয়ে।
রৌদ্র ধু ধু করছে পাশের সেই খোলা ছাদে

তার স্পষ্ট আলোয় বিগত বসন্ত রাত্রের বিহ্বলতা
সে দিয়েছে ঘুচিয়ে।
নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ল আলো মাঠেবাটে,
মহাজনের টিনের ছাদে,
শাক্সব্জীর ঝুড়ি চুপড়িতে,
আঁটিবাঁধা খড়ে,
হাঁড়ি মালসার স্তূপে,
নতুন গুড়ের কলসীর গায়ে।
সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিল
মহানীম গাছের ফুলের মঞ্জরীতে।।
পথের ধারে তালের গুঁড়ি আঁকড়ে উঠেছে অশথ,
অন্ধ বৈরাগী তারি ছায়ায় গান গাইছে হাঁড়ি বাজিয়ে-

-কাল আসব ব’লে চলে গেল
আমি যে সেই কালের দিকে তাকিয়ে আছি।-

কেনাবেচার বিচিত্র গােলমালের জমিনে
ঐ সুরের শিল্পে বুনে উঠছে
যেন সমস্ত বিশ্বের একটা উৎকণ্ঠার মন্ত্র-
“তাকিয়ে আছি।”
একজোড়া মােষ উদাস চোখ মেলে
বয়ে চলেছে বোঝাই গাড়ি,
গলায় বাজছে ঘণ্টা,
চাকার পাকে পাকে টেনে তুলছে কাতর ধ্বনি।
আকাশের আলোয় আজ যেন মেঠো বাঁশির সুর মেলে-দেওয়া।
সব জড়িয়ে মন ভুলেছে।
বেদমন্ত্রের ছন্দে
আবার মন বললে-
মধুময় এই পার্থিব ধুলি।

কেরোসিনের দোকানের সামনে
চোখে পড়ল একজন এ-কেলে বাউল।
তালিদেওয়া আলখাল্লার উপরে
কোমরে-বাঁধা একটা বাঁয়া।
লোক জমেছে চারিদিকে।
হাসলেম, দেখলেম অদ্ভুতেরও সংগতি আছে এইখানে,
এ-ও এসেছে হাটের ছবি ভর্তি করতে।

ওকে ডেকে নিলেম জানলার কাছে,
ও গাইতে লাগল-

হাট করতে এলেম আমি অধরার সন্ধানে,
সবাই ধরে টানে আমায়, এই যে গো এইখানে।।

শান্তিনিকেতন
২৫ অক্টোবর, ১৯৩৫