স্বপ্ন

(১)

তোমায় আমি দেখিনা কো, শুধু তোমার স্বপ্ন দেখি,
তুমি আমায় বারে বারে শুধাও, “ওগো সত্য সে কি?”
কি জানি গো, হয়-তো বুঝি
তোমার মাঝে কেবল খুঁজি
এই-জনমের রূপের তলে আর-জনমের ভাবের স্মৃতি।
হয়-তো হেরি তোমার চোখে
আদি যুগের ইন্দ্রলোকে
শিশু চাঁদের পথ-ভোলানো পারিজাতের ছায়া-বীথি।
এই কূলেতে ডাকি যখন সাড়া যে দাও সেই ও-পারে,
পরশ তোমার ছাড়িয়ে কায়া বাজে মায়ার বীণার তারে।
হয়-তো হবে সত্য তাই,
হয়-তো তোমার স্বপন, আমার আপন মনের মত্ততাই।।

(২)

আমি বলি স্বপ্ন যাহা তা’র চেয়ে কি সত্য আছে?
যে-তুমি মোর দূরের মানুষ সেই-তুমি মোর কাছের কাছে।
সেই-তুমি আর নও তো বাঁধন,
স্বপ্নরূপে মুক্তি – সাধন,
ফুলের সাথে তারার সাথে তোমার সাথে সেথায় মেলা।
নিত্যকালের বিদেশিনী,
তোমায় চিনি, নাই বা চিনি,
তোমার লীলায় ঢেউ তুলে যায় কভু সোহাগ, কভু হেলা।
চিত্তে তোমার মূর্ত্তি নিয়ে ভাবসাগরের খেয়ায় চড়ি।
বিধির মনের কল্পনারে আপন মনে নতুন গড়ি।
আমার কাছে সত্য তাই,
মন-ভরানো পাওয়ায় ভরা বাইরে-পাওয়ার ব্যর্থতাই।।

(৩)

আপ্নি তুমি দেখেছো কি আপন মাঝে সত্য কি যে?
দিতে যদি চাও তা কা’রে, দিতে কি তাই পারো নিজে
হয়তো তা’রে দুঃখ দিনে
অগ্নি-আলোয় পাবে চিনে,
তখন তোমার নিবিড় বেদন নিবেদনের জ্বাল্বে শিখা।
অমৃত যে হয়নি মথন,
তাই তোমাতে এই অযতন;
তাই তোমারে ঘিরে আছে ছলন-ছায়ার কুহেলিকা।
নিত্যকালের আপন তোমায় লুকিয়ে বেড়ায় মিথ্যা সাজে।
ক্ষণে ক্ষণে ধরা পড়ে শুধু আমার স্বপন-মাঝে।
আমি জানি সত্য তাই,
মরণ-দুঃখে অমর জাগে, অমৃতেরি তত্ত্ব তাই।।

(8)

পুষ্পমালার গ্রন্থিখানা অনাদরে পড়ুক ছিঁড়ে,
ফুরাক্ বেলা, জীর্ণ খেলা হারাক হেলা-ফেলার ভিড়ে।
ছল ক’রে যা পিছু ডাকে
পিছন ফিরে চাস্নে তাকে,
ডাকে না যে যাবার বেলায় যাস্নে তাহার পিছে পিছে।
যাওয়া-আসা-পথের ধূলায়
চপল পায়ের চিহ্নগুলায়
গ’ণে গ’ণে আপন মনে কাটাস্নে দিন মিছে মিছে।
কি হ’বে তোর বোঝাই ক’রে ব্যর্থ দিনের আবর্জ্জনা;
স্বপ্ন শুধুই মর্ত্ত্যে অমর, আর সকলি বিড়ম্বনা।
নিত্য প্রাণের সত্য তাই,
প্রাণ দিয়ে তুই রচিস যা’রে, – অসীম পথের পথ্য তাই।।

আণ্ডেস্ জাহাজ,
২০ অক্টোবর, ১৯২৪।