ষষ্ঠ সর্গ

‘কমলা ভুলিবে সেই শিখর কানন,
কমলা ভুলিবে সেই বিজন কুটীর
আজ হতে নেত্র! বারি কোরো না বর্ষণ,
আজ হতে মন প্রাণ হও গো সুস্থির।

অতীত ও ভবিষ্যত হইব বিসমৃত।
জুড়িয়াছে কমলার ভগন হৃদয়!
সুখের তরঙ্গ হৃদে হয়েছে উত্থিত,
সংসার আজিকে হোতে দেখি সুখময়।

বিজয়েরে আর করিব না তিরস্কার
সংসারকাননে মোরে আনিয়াছে বলি।
খুলিয়া দিয়াছে সে যে হৃদয়ের দ্বার,
ফুটায়েছে হৃদয়ের অস্ফুটিত কলি!

জমি জমি জলরাশি পর্ব্বতগুহায়
একদিন উথলিয়া উঠে রে উচ্ছ্বাসে,
একদিন পূর্ণ বেগে প্রবাহিয়া যায়,
গাহিয়া সুখের গান যায় সিন্ধুপাশে।

আজি হতে কমলার নূতন উচ্ছ্বাস,
বহিতেছে কমলার নূতন জীবন।
কমলা ফেলিবে আহা নূতন নিশ্বাস,
কমলা নূতন বায়ু করিবে সেবন।

কাঁদিতে ছিলাম কাল বকুলতলায়,
নিশার আঁধারে অশ্রু করিয়া গোপন!
ভাবিতে ছিলাম বসি পিতায় মাতায়
জানি না নীরদ আহা এয়েছে কখন।

সেও কি কাঁদিতে ছিল পিছনে আমার?
সেও কি কাঁদিতে ছিল আমারি কারণ?
পিছনে ফিরিয়া দেখি মুখপানে তার,
মন যে কেমন হল জানে তাহা মন।

নীরদ কহিল হৃদি ভরিয়া সুধায়
‘শোভনে! কিসের তরে করিছ রোদন?’
আহা হা! নীরদ যদি আবার শুধায়,
‘কমলে! কিসের তরে করিছ রোদন?’

বিজয়েরে বলিয়াছি প্রাতঃকালে কাল
একটি হৃদয়ে নাই দুজনের স্থান!
নীরদেই ভালবাসা দিব চিরকাল,
প্রণয়ের করিব না কভু অপমান।

ওই যে নীরজা আসে পরাণ-সজনী,
একমাত্র বন্ধু মোর পৃথিবীমাঝার!
হেন বন্ধু আছে কি রে নির্দ্দয় ধরণী!
হেন বন্ধু কমলা কি পাইবেক আর?

ওকি সখি কোথা যাও? তুলিবে না ফুল?
নীরজা, আজিকে সই গাঁথিবে না মালা?
ওকি সখি আজ কেন বাঁধ নাই চুল?
শুকনো শুকনো মুখ কেন আজি বালা?

মুখ ফিরাইয়া কেন মুছ আঁখিজল?
কোথা যাও, কোথা সই, যেও না, যেও না!
কি হয়েছে? বল্‌বি নে বল্‌ সখি বল্‌!
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা?’

‘কি হয়েছে, কে দিয়েছে, বলি গো সকল।
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা
ফেলিব যে চিরকাল নয়নের জল
নিভায়ে ফেলিতে বালা মরমবেদনা!

কে দিয়েছে মনমাঝে জ্বালায়ে অনল?
বলি তবে তুই সখি তুই! আর নয়
কে আমার হৃদয়েতে ঢেলেছে গরল?
কমলারে ভালবাসে আমার বিজয়!

কেন হলুম না বালা আমি তোর মত,
বন হতে আসিতাম বিজয়ের সাথে
তোর মত কমলা লো মুখ আঁখি যত
তা হলে বিজয়-মন পাইতাম হাতে!

পরাণ হইতে অগ্নি নিভিবে না আর
বনে ছিলি বনবালা সে ত বেশ ছিলি
জ্বালালি! জ্বলিলি বোন! খুলি মর্ম্মদ্বার
কাঁদিতে করিগে যত্ন যেথা নিরিবিলি’।

কমলা চাহিয়া রয়, নাহি বহে শ্বাস।
হৃদয়ের গূঢ় দেশে অশ্রুরাশি মিলি
ফাটিয়া বাহির হতে করিল প্রয়াস
কমলা কহিল ধীরে “জ্বালালি জ্বলিলি!”

আবার কহিল ধীরে, আবার হেরিল নীরে
যমুনাতরঙ্গে খেলে পূর্ণ শশধর
তরঙ্গের ধারে ধারে রঞ্জিয়া রজতধারে
সুনীল সলিলে ভাসে রজন্ময় কর!

হেরিল আকাশ-পানে সুনীল জলদযানে
ঘুমায়ে চন্দ্রিমা ঢালে হাসি এ নিশীথে।
কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে পাগল বনের মেয়ে
আকুল কত কি মনে লাগিত ভাবিতে!

‘ওই খানে আছে পিতা, ওই খানে আছে মাতা,
ওই জ্যোৎসনাময় চাঁদে করি বিচরণ
দেখিছেন হোথা হোতে দাঁড়ায়ে সংসারপথে
কমলা নয়নবারি করিছে মোচন।

একি রে পাপের অশ্রু? নীরদ আমার
নীরদ আমার যথা আছে লুক্কায়িত,
সেই খান হোতে এই অশ্রুবারিধার
পূর্ণ উৎস-সম আজ হল উৎসারিত।

এ ত পাপ নয় বিধি! পাপ কেন হবে?
বিবাহ করেছি বলে নীরদে আমার
ভাল বাসিব না? হায় এ হৃদয় তবে
বজ্র দিয়া দিক বিধি করে চুরমার!

এ বক্ষে হৃদয় নাই, নাইক পরাণ,
একখানি প্রতিমূর্ত্তি রেখেছি শরীরে
রহিবে, যদিন প্রাণ হবে বহমান
রহিবে, যদিন রক্ত রবে শীরে শীরে!

সেই মূর্ত্তি নীরদের! সে মূর্ত্তি মোহন
রাখিলে বুকের মধ্যে পাপ কেন হবে?
তবুও সে পাপ আহা নীরদ যখন
বলেছে, নিশ্চয় তারে পাপ বলি তবে!

তবু মুছিব না অশ্রু এ নয়ান হোতে,
কেন বা জানিতে চাব পাপ কারে বলি?
দেখুক জনক মোর ওই চন্দ্র হোতে
দেখুন জননী মোর আঁখি দুই মেলি!

নীরজা গাইত ‘চল্‌ চন্দ্রলোকে রবি।
সুধাময় চন্দ্রলোক, নাই সেথা দুখ শোক,
সকলি সেথায় নব ছবি!

ফুলবক্ষে কীট নাই, বিদ্যুতে অশনি নাই,
কাঁটা নাই গোলাপের পাশে!
হাসিতে উপেক্ষা নাই, অশ্রুতে বিষাদ নাই,
নিরাশার বিষ নাই শ্বাসে।

নিশীথে আঁধার নাই, আলোকে তীব্রতা নাই,
কোলাহল নাইক দিবায়!
আশায় নাইক অন্ত, নূতনত্বে নাই অন্ত,
তৃপ্তি নাই মাধুর্য্যশোভায়।

লতিকা কুসুমময়, কুসুম সুরভিময়,
সুরভি মৃদুতাময় যেথা!
জীবন স্বপনময়, স্বপন প্রমোদময়,
প্রমোদ নূতনময় সেথা!

সঙ্গীত উচ্ছ্বাসময়, উচ্ছ্বাস মাধুর্য্যময়,
মাধুর্য্য মত্ততাময় অতি।
প্রেম অস্ফুটতামাখা, অস্ফুটতা স্বপ্নমাখা,
স্বপ্নে-মাখা অস্ফুটিত জ্যোতি!

গভীর নিশীথে যেন, দূর হোতে স্বপ্ন-হেন
অস্ফুট বাঁশীর মৃদু রব
সুধীরে পশিয়া কানে শ্রবণ হৃদয় প্রাণে
আকুল করিয়া দেয় সব।

এখানে সকলি যেন অস্ফুট মধুর-হেন,
উষার সুবর্ণ জ্যোতি-প্রায়।
আলোকে আঁধার মিশে মধু জ্যোছনায় দিশে
রাখিয়াছে ভরিয়া সুধায়!

দূর হোতে অপ্সরার মধুর গানের ধার,
নির্ঝরের ঝর ঝর ধ্বনি।
নদীর অস্ফুট তান মলয়ের মৃদুগান
একত্তরে মিশেছে এমনি!

সকলি অস্ফুট হেথা মধুর স্বপনে-গাঁথা
চেতনা মিশান’ যেন ঘুমে।
অশ্রু শোক দুঃখ ব্যথা কিছুই নাহিক হেথা
জ্যোতির্ম্ময় নন্দনের ভূমে!’

আমি যাব সেই খানে পুলকপ্রমত্ত প্রাণে
সেই দিনকার মত বেড়াব খেলিয়া
বেড়াব তটিনীতীরে, খেলাব তটিনীনীরে,
বেড়াইব জ্যোছনায় কুসুম তুলিয়া!

শুনিছি মৃত্যুর পিছু পৃথিবীর সব-কিছু
ভুলিতে হয় নাকি গো যা আছে এখানে!
ওমা! সে কি করে হবে? মরিতে চাই না তবে
নীরদে ভুলিতে আমি চাব কোন্‌ প্রাণে?’

কমলা এতেক পরে হেরিল সহসা
নীরদ কাননপথে যাইছে চলিয়া
মুখপানে চাহি রয় বালিকা বিবশা,
হৃদয়ে শোণিতরাশি উঠে উথলিয়া।

নীরদের স্কন্ধে খেলে নিবিড় কুন্তল,
দেহ আবরিয়া রহে গৈরিক বসন,
গভীর ঔদাস্যে যেন পূর্ণ হৃদিতল
চলিছে যে দিকে যেন চলিছে চরণ।

যুবা কমলারে দেখি ফিরাইয়া লয় আঁখি,
চলিল ফিরায়ে মুখ দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
যুবক চলিয়া যায় বালিকা তবুও হায়!
চাহি রয় একদৃষ্টে আঁখিদ্বয় মেলি।

ঘুম হতে যেন জাগি সহসা কিসের লাগি
ছুটিয়া পড়িল গিয়া নীরদের পায়।
যুবক চমকি প্রাণে হেরি চারি দিক-পানে
পুনঃ না করিয়া দৃষ্টি ধীরে চলি যায়।

‘কোথা যাও কোথা যাও নীরদ! যেও না!
একটি কহিব কথা শুন একবার!
মুহূর্ত্ত মুহূর্ত্ত রও পুরাও কামনা!
কাতরে দুখিনী আজি কহে বার বার!

জিজ্ঞাসা করিবে নাকি আজি যুবাবর
‘কমলা কিসের তরে করিছ রোদন?’
তা হলে কমলা আজি দিবেক উত্তর,
কমলা খুলিবে আজি হৃদয়বেদন।

দাঁড়াও দাঁড়াও যুবা! দেখি একবার,
যেথা ইচ্ছা হয় তুমি যেও তার পর!
কেন গো রোদন করি শুধাও আবার,
কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর!

কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর,
কমলা হৃদয় খুলি দেখাবে তোমায়
সেথায় রয়েছে লেখা দেখো তার পর
কমলা রোদন করে কিসের জ্বালায়!’

‘কি কব কমলা আর কি কব তোমায়,
জনমের মত আজ লইব বিদায়!
ভেঙ্গেছে পাষাণ প্রাণ, ভেঙ্গেছে সুখের গান
এ জন্মে সুখের আশা রাখি নাক আর!

এ জন্মে মুছিব নাক নয়নের ধার!
কত দিন ভেবেছিনু যোগীবেশ ধরে
ভ্রমিব যেথায় ইচ্ছা কানন-প্রান্তরে।

তবু বিজয়ের তরে এত দিন ছিনু ঘরে
হৃদয়ের জ্বালা সব করিয়া গোপন
হাসি টানি আনি মুখে এত দিন দুখে দুখে
ছিলাম, হৃদয় করি অনলে অর্পণ!

কি আর কহিব তোরে কালিকে বিজয় মোরে
কহিল জন্মের মত ছাড়িতে আলয়!
জানেন জগৎস্বামী বিজয়ের তরে আমি
প্রেম বিসর্জ্জিয়াছিনু তুষিতে প্রণয়।’

এত বলি নীরবিল ক্ষুব্ধ যুবাবর!
কাঁপিতে লাগিল কমলার কলেবর,
নিবিড় কুন্তল যেন উঠিল ফুলিয়া
যুবারে সম্ভাষে বালা, এতেক বলিয়া

‘কমলা তোমারে আহা ভালবাসে বোলে
তোমারে করেছে দূর নিষ্ঠুর বিজয়!
প্রেমেরে ডুবাব আজি বিসমৃতির জলে,
বিসমৃতির জলে আজি ডুবাব হৃদয়!

তবুও বিজয় তুই পাবি কি এ মন?
নিষ্ঠুর! আমারে আর পাবি কি কখন?
পদতলে পড়ি মোর দেহ কর ক্ষয়
তবু কি পারিবি চিত্ত করিবারে জয়?
তুমিও চলিলে যদি হইয়া উদাস

কেন গো বহিব তবে এ হৃদি হতাশ?
আমিও গো আভরণ ভূষণ ফেলিয়া
যোগিনী তোমার সাথে যাইব চলিয়া।

যোগিনী হইয়া আমি জন্মেছি যখন
যোগিনী হইয়া প্রাণ করিব বহন।
কাজ কি এ মণি মুক্তা রজত কাঞ্চন
পরিব বাকলবাস ফুলের ভূষণ।

নীরদ! তোমার পদে লইনু শরণ
লয়ে যাও যেথা তুমি করিবে গমন!
নতুবা যমুনাজলে এখনই অবহেলে
ত্যজিব বিষাদদগ্ধ নারীর জীবন!’

পড়িল ভূতলে কেন নীরদ সহসা?
শোণিতে মৃত্তিকাতল হইল রঞ্জিত!
কমলা চমকি দেখে সভয়ে বিবশা
দারুণ ছুরিকা পৃষ্ঠে হয়েছে নিহিত!

কমলা সভয়ে শোকে করিল চিৎকার।
রক্তমাখা হাতে ওই চলিছে বিজয়!
নয়নে আঁচল চাপি কমলা আবার
সভয়ে মুদিয়া আঁখি স্থির হয়ে রয়।

আবার মেলিয়া আঁখি মুদিল নয়নে,
ছুটিয়া চলিল বালা যমুনার জলে
আবার আইল ফিরি যুবার সদনে,
যুমনা-শীতল জলে ভিজায়ে আঁচলে।

যুবকের ক্ষত স্থানে বাঁধিয়া আঁচল
কমলা একেলা বসি রহিল তথায়
এক বিন্দু পড়িল না নয়নের জল,
এক বারো বহিল না দীর্ঘশ্বাস-বায়।

তুলি নিল যুবকের মাথা কোল-পরে
একদৃষ্টে মুখপানে রহিল চাহিয়া।
নির্জ্জীব প্রতিমা-প্রায় না নড়ে না চড়ে,
কেবল নিশ্বাস মাত্র যেতেছে বহিয়া।

চেতন পাইয়া যুবা কহে কমলায়,
‘যে ছুরীতে ছিঁড়িয়াছে জীবনবন্ধন
অধিক সুতীক্ষ্ম ছুরী তাহা অপেক্ষায়
আগে হোতে প্রেমরজ্জু করেছে ছেদন।

বন্ধুর ছুরিকা-মাখা দ্বেষহলাহলে
করেছে হৃদয়ে দেহে আঘাত ভীষণ,
নিবেছে দেহের জ্বালা হৃদয়-অনলে
ইহার অধিক আর নাইক মরণ!

বকুলের তলা হোক্‌ রক্তে রক্তময়!
মৃত্তিকা রঞ্জিত হোক্‌ লোহিত বরণে!
বসিবে যখন কাল হেথায় বিজয়
আচ্ছন্ন বন্ধুতা পুনঃ উদিবে না মনে?

মৃত্তিকার রক্তরাগ হোয়ে যাবে ক্ষয়
বিজয়ের হৃদয়ের শোণিতের দাগ
আর কি কখনো তার হবে অপচয়?
অনুতাপ-অশ্রুজলে মুছিবে সে রাগ?

বন্ধুতার ক্ষীণ জ্যোতি প্রেমের কিরণে
(রবিকরে হীনভাতি নক্ষত্র যেমন)
বিলুপ্ত হয়েছে কি রে বিজয়ের মনে?
উদিত হইবে না কি আবার কখন?

একদিন অশ্রুজল ফেলিবে বিজয়!
একদিন অভিশাপ দিবে ছুরিকারে!
একদিন মুছিবারে হইতে হৃদয়
চাহিবে সে রক্তধারা অশ্রুবারিধারে!

কমলে! খুলিয়া ফেল আঁচল তোমার!
রক্তধারা যেথা ইচ্ছা হোক প্রবাহিত!
বিজয় শুধেছে আজি বন্ধুতার ধার
প্রেমেরে করায়ে পান বন্ধুর শোণিত!

চলিনু কমলা আজ ছাড়িয়া ধরায়
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িয়া বন্ধন,
জলাঞ্জলি দিয়া পৃথিবীর মিত্রতায়,
প্রেমের দাসত্ব রজ্জু করিয়া ছেদন!”

অবসন্ন হোয়ে পঞ্চল যুবক তখনি,
কমলার কোল হোতে পড়িল ধরায়!
উঠিয়া বিপিনবালা সবেগে অমনি
ঊর্দ্ধহস্তে কহে উচ্চ সুদৃঢ় ভাষায়

‘জলন্ত জগৎ! ওগো চন্দ্র সূর্য্য তারা!
দেখিতেছ চিরকাল পৃথিবীর নরে!
পৃথিবীর পাপ পুণ্য, হিংসা, রক্তধারা
তোমরাই লিখে রাখ জ্বলদ্‌ অক্ষরে!

সাক্ষী হও তোমরা গো করিও বিচার!
তোমরা হও গো সাক্ষী পৃথ্বী চরাচর!
বহে যাও! বহে যাও যমুনার ধার,
নিষ্ঠুর কাহিনী কহি সবার গোচর!

এখনই অস্তাচলে যেও না তপন!
ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি দিনকর!
এই, এই রক্তধারা করিয়া শোষণ
লয়ে যাও, লয়ে যাও স্বর্গের গোচর!

ধুস্‌ নে যমুনাজল! শোণিতের ধারে!
বকুল তোমার ছায়া লও গো সরিয়ে!
গোপন করো না উহা নিশীথ! আঁধারে!
জগৎ! দেখিয়া লও নয়ন ভরিয়ে!

অবাক হউক্‌ পৃথ্বী সভয়ে, বিস্ময়ে!
অবাক হইয়া যাক্‌ আঁধার নরক!
পিশাচেরা লোমাঞ্চিত হউক সভয়ে!
প্রকৃতি মুদুক ভয়ে নয়নপলক!

রক্তে লিপ্ত হয়ে যাক্‌ বিজয়ের মন!
বিসমৃতি! তোমার ছায়ে রেখো না বিজয়ে;
শুকালেও হৃদিরক্ত এ রক্ত যেমন
চিরকাল লিপ্ত থাকে পাষাণ হৃদয়ে!

বিষাদ! বিলাসে তার মাখি হলাহল
ধরিও সমুখে তার নরকের বিষ!
শান্তির কুটীরে তার জ্বালায়ো অনল!
বিষবৃক্ষবীজ তার হৃদয়ে রোপিস্‌!

দূর হ দূর হ তোরা ভূষণ রতন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!
আবার কবরি! তোরে করিনু মোচন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!

কি বলিস্‌ যমুনা লো! কমলা বিধবা!
জাহ্নবীরে বল্‌ গিয়ে ‘কমলা বিধবা’!
পাখী! কি করিস্‌ গান ‘কমলা বিধবা!
দেশে দেশে বল্‌ গিয়ে ‘কমলা বিধবা!

আয়! শুক ফিরে যা লো বিজন শিখরে,
মৃগদের বল্‌ গিয়া উঁচু করি গলা
কুটীরকে বল্‌ গিয়ে, তটিনী, নির্ঝরে
‘বিধবা হয়েছে সেই বালিকা কমলা!’

উহুহু! উহুহু আর সহিব কেমনে?
হৃদয়ে জ্বলিছে কত অগ্নিরাশি মিলি।
বেশ ছিনু বনবালা, বেশ ছিনু বনে!
নীরজা বলিয়া গেছে ‘জ্বালালি! জ্বলিলি!’