তেঁতুলের ফুল

জীবনের অনেক, ধন পাই নি,
নাগালের বাইরে তারা;
হারিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি
হাত পাতি নি ব’লেই।
সেই চেনা সংসারে
অসংস্কৃত পল্লীরূপসীর মতো
ছিল এই ফুল মুখঢাকা,
অকাতরে উপেক্ষা করেছে উপেক্ষাকে
এই তেঁতুলের ফুল।

বেঁটে গাছ পাঁচিলের ধারে,
বাড়তে পারে নি কৃপণ মাটিতে;
উঠেছে ঝাঁকড়া ডাল মাটির কাছ ঘেঁষে।
ওর বয়স হয়েছে যায় নি বোঝা।

অদূরে ফুটেছে নেবুফুল,
গাছ ভরেছে গোলকচাঁপায়,
কোণের গাছে ধরেছে কাঞ্চন,
কুড়চি-শাখা ফুলের তপস্যায় মহাশ্বেতা।
স্পষ্ট ওদের ভাষা,
ওরা আমাকে ডাক দিয়ে করেছে আলাপ।
আজ যেন হঠাৎ এল কানে
কোন্ ঘোমটার নীচে থেকে চুপিচুপি কথা।
দেখি পথের ধারে তেঁতুলশাখার কোণে
লাজুক একটি মঞ্জরী,
মৃদু বসন্তী রঙ,
মৃদু একটি গন্ধ,
চিকন লিখন তার পাপড়ির-গায়ে।
শহরের বাড়িতে আছে
শিশুকাল থেকে চেনাশোনা অনেক কালের তেঁতুল গাছ,
দিকপালের মতো দাঁড়িয়ে
উত্তরপশ্চিম কোণে,
পরিবারের যেন পুরোনো কালের সেবক,
প্রপিতামহের বয়সী।
এই বাড়ির অনেক জন্মমৃত্যুর পর্বের পর পর্বে
সে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে,
যেন বোবা ইতিহাসের সভাপণ্ডিত।
ওই গাছে ছিল যাদের নিশ্চিত দখল কালে কালে
তাদের কত লোকের নাম
আজ ওর ঝরা পাতার চেয়েও ঝরা,
তাদের কত লোকের স্মৃতি
ওর ছায়ার চেয়েও ছায়া।

একদিন ঘোড়ার আস্তাবল ছিল ওর তলায়
খুরের খট্খটানিতে অস্থির
খোলার-চালা-দেওয়া ঘরে।
কবে চলে গেছে সহিসের হাঁক-ডাকা।
সেই ঘোড়া-বাহনের যুগ
ইতিবৃত্তের ওপারে।
আজ চুপ হয়েছে হ্রেষাধ্বনি,
রঙ বদল করেছে কালের ছবি।
সর্দার কোচম্যানের সযত্নসজ্জিত দাড়ি,
চাবুক হাতে তার সগর্ব উদ্ধত পদক্ষেপ,
সেদিনকার শৌখিন সমারোহের সঙ্গে
গেছে সাজ-পরিবর্তনের মহানেপথ্যে।
দশটা বেলার প্রভাত-রৌদ্রে
ওই তেঁতুলতলা থেকে এসেছে দিনের পর দিন
অবিচলিত নিয়মে ইস্কুলে যাবার গাড়ি।
বালকের নিরুপায় অনিচ্ছার বোঝাটা
টেনে নিয়ে গেছে রাস্তার ভিড়ের মাঝখান দিয়ে।

আজ আর চেনা যাবে না সেই ছেলেকে-
না দেহে, না মনে, না অবস্থায়।
কিন্তু চিরদিন দাঁড়িয়ে আছে
যেই আত্মসমাহিত তেঁতুল গাছ
মানবভাগ্যের ওঠানামার প্রতি
ভ্রূক্ষেপ না ক’রে।
মনে আছে একদিনের কথা।
রাত্রি থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি;
ভোরের বেলায় আকাশের রঙ
যেন পাগলের চোখের তারা।
দিক্হারানো ঝড় বইছে এলোমেলো,
বিশ্বজোড়া অদৃশ্য খাঁচায় মহাকায় পাখি
চার দিকে ঝাপট মারছে পাখা।
রাস্তায় দাঁড়ালো জল,
আঙিনা গেছে ভেসে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি,
ক্রুদ্ধ মুনির মতো ওই গাছ মাথা তুলেছে আকাশে,
তার শাখায় শাখায় ভর্ৎসনা।
গলির দুই ধারে কোঠাবাড়িগুলো হতবুদ্ধির মতো,
আকাশের অত্যাচারে
প্রতিবাদ করবার ভাষা নেই তাদের।
একমাত্র ওই গাছটার পত্রপুঞ্জের আন্দোলনে
আছে বিদ্রোহের বাণী,
আছে স্পর্ধিত অভিসম্পাত।
অন্তহীন ইঁটকাঠের মূক জড়তার মধ্যে
ওই ছিল একা মহারণ্যের প্রতিনিধি;
সেদিন দেখেছি তার বিক্ষুব্ধ মহিমা বৃষ্টিপাণ্ডুর দিগন্তে।

কিন্তু যখন বসন্তের পর বসন্ত এসেছে,
অশোক বকুল পেয়েছে সম্মান;
ওকে জেনেছি যেন ঋতুরাজের বাহির-দেউড়ির দ্বারী,
উদাসীন, উদ্ধত।
সেদিন কে জেনেছিল-
ওই রূঢ় বৃহতের অন্তরে সুন্দরের নম্রতা,
কে জেনেছিল বসন্তের সভায় ওর কৌলীন্য
ফুলের পরিচয়ে আজ ওকে দেখছি।
যেন গন্ধর্ব চিত্ররথ,
যে ছিল অর্জুনবিজয়ী মহারথী
গানের সাধন করছে সে আপন মনে একা
নন্দনবনের ছায়ার আড়ালে গুন গুন সুরে।
সেদিনকার কিশোর কবির চোখে
ওই প্রৌঢ় গাছের গোপন যৌবনমদিরতা
যদি ধরা পড়ত উপযুক্ত লগ্নে,
মনে আসছে, তবে
মৌমাছির পাখা-উতল-করা
কোন্-এক পরম দিনের তরুণ প্রভাতে
একটি ফুলের গুচ্ছ করতেম চুরি
পরিয়ে দিতেম কেঁপে-ওঠা আঙুল দিয়ে
কোন্ একজনের আনন্দে-রাঙা কর্ণমূলে।
যদি সে শুধাত, কী নাম,
হয়তো বলতেম,-
ওই যে রৌদ্রের এক টুকরো পড়েছে তোমার চিবুকে
ওর যদি কোনো নাম তোমার মুখে আসে
একেও দেব সেই নামটি।

শান্তিনিকেতন
৭ জুন, ১৯৩৬