খুটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা

১.
থুয়ে যাও তুমি তোমার খোপার ফুল,
সরল খোয়াবে জড়ায়ে রাখবো তারে।
আমি তারে মনে ভাববো আমার কূল,
বৃক্ষের ছায়া বিরান পথের ধারে।

আমি তারে মনে ভেবে নেবো ভালোবাসা,
পরানের কাছে পরানের লেখা চিঠি
নিরব জবানে রচনা সর্বনাশা।
দূর আসমানে তারাদের মিটিমিটি-

পরম পিরতে আবডালে ভেঙে ফ্যালা
হলো না তোমার, এখনো শরম জ্বলে,
এখনো নুর চারপাশে মেঘ ম্যালা,
ভেজেনি শরীর গাঢ় বৃষ্টির জলে।
তাই দরিদ্র বাসনাটি রাখি মেলে,
থুয়ে যাও, যাও খোঁপার ফুলটি ফেলে।।

(০৩.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

২.
হাতখানা রাখো ঠিক কপালের ‘পরে,
বিশ্বাস করো করি না ছলনা কোনো,
পুড়ছে শরীর অতিলৌকিক জ্বরে।
পাষান জড়তা ঝেড়ে ফেলে দাও, শোনোঃ

স্পর্শের চে’ পবিত্র কিছু নেই,
প্রকৃতির এই পূর্ন পরিধি জুড়ে
প্রত্যেকে চায় ছুঁতে হোক যেভাবেই,
প্রজাপতি আসে ফুলের শরীরে উড়ে।

জল ছুঁয়ে যায় তীরের চিবুক চিল
বাতাসে ডানার ছোঁয়া রেখে ভাসে নীলে।
থেকো না হৃদয়-দরোজায় এঁটে খিল,
ছোঁয়া দিতে দাও তোমার ঠোঁটের তিলে।
ডানা ঝাপটায় পাখিটি বুকের ঘরে,
পুড়ে যায় তনু অতিলৌকিক জ্বরে।।

(০৩.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৩.
বহুদিন পরে দ্যাখা হলো জনপদে,
লাবন্য ঝরা দুপুরের ফুল যেন,
যেন বালুচর জেগেছে স্রোতের নদে।
চোখের শিয়রে কালিমা জমেছে কেন?

কুশল শুধতে উত্তর দিলে চোখে,
বুঝতে পারিনি, ব্যাকরন গেছি ভুলে।
জড়বাদিতায় গিয়েছি বড্ড বোখে,
এখনো রয়েছি বস্তুতন্ত্রে ঝুলে।

মনে হয় দেখে আমিষে শর্করায়
মিলেমিশে বেশ হয়েছে মানিকজোড়।
মিটে গেছে সব জীবনের দেনা দায়,
প্রয়োজন নেই ম্যারাথন কোনো দৌড়।

বাসনারা ঘোরে নিরালোক জনপদে,
আমাকে খেয়েছে ভালোবেসে প্রিয় মদে।।

(২২.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৪.
ডুবিয়েছিলাম স্বপ্ন বোঝাই নাও,
এখন দেখছি এ যে এক বিস্ময়!
নৌকো ডুবেছে স্বপ্নেরা ভেসে যায়-
নাওখানা তবে হারালাম আমি ফাও?

স্বপ্ন বিষয়ে আমার ধারনা কম,
খুশিতে ছিলাম গোপনে নিজেকে বোলেঃ
দিয়েছি বেকুব স্বপ্নের কান ম’লে,
ডুবিয়ে দিয়েছি রনতরী যেরকম।

দেখছি এখন স্বপ্নেরা ভাসে জলে,
সাঁতরায় রাজহংসের অনুরূপ।
বেগতিক বুঝে হয়ে আছি নিশ্চুপ,
পড়েছি বেতাল অভাবিত গ্যাড়াকলে।

স্বপ্ন ডুবিয়ে নির্ভার হতে চেয়ে,
ডুবছি এখন স্বপ্নের বোঝা বয়ে।।

(২৩.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৫.
পা দুখানি শুধু ছোঁয়া যায় কোনো মতে,
এমনি সুযোগ এমনি পরিস্থিতি।
বিধাহীন হাতে জেগে ওঠে পদপ্রীতি,
ধেয়ে পেয়ে আসে নিন্দুক শতে শতে।

তুমিও বেজায় শরমে বলছোঃ ছি ছি,
এ কি অশোভন? কি যে এ কেলেংকারি!
আমিও বেকুব, মালকোচা মেরে সারি,
ভূত ভবিষ্যৎ নাড়িচাড়ি মিছেমিছি।

স্বরসতি প্রেমে হয়ে থাকি মশগুল,
তাই কি এমন অধপাতে গেছি নেমে?
এইখানে এসে চিন্তারা যায় থেমে,
গেয়ে ওঠে সুরে জবাবের বুলবুল-

পা ছুঁয়েছি শুধু আর সব র’লো বাকি,
নারী তো নারীই নারীর আবার পা কি??

(২৩.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৬.
আগে শুধু ছিলো কুঁড়ে ও নিন্দুকেরা,
আর কতিপয় অবোধ পালের গোদা।
যেই নিয়ামত পাঠিয়ে দিয়েছে খোদা,
অপরূপ তা যে, সব পানীয়র সেরা।

তারও পেছনে লেগেছে এখন দেখি
দুরাশাগ্রস্ত রাষ্ট্রিয় তক্ষক।
নয় তারা মোটে স্বপ্নের রক্ষক,
অন্যের অনুরোধেই গিলেছে ঢেঁকি।

কেন নিষেধের পতাকা উড়িয়ে আসো?
অকারনে তোলো নিন্দার সোরগোল?
এর মাঝে পাবে মহাবিশ্বের দোল,
খুঁজে দ্যাখো, ভাবো, তারপর ভালোবাসো।

আমিও কি ছাই চেয়েছি এসব খেতে!
শরাব হয়েছে মাতাল আমাকে পেতে।।

(২৩.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৭.
গোলেমালে চ’লে যাচ্ছে কেবলি দিন।
বিশশতকের যন্ত্রপাতির কাছে
খুঁজে পেতে দেখি রয়েছে অঢেল ঋন,
গ্রন্থ-কেতাবে সবি তার লেখা আছে।

যানবাহনের বিস্ময়কর গতি
শীর্ন করেছে প্রাকৃতিক পা দুখান,
লোকালয় থেকে বৃক্ষরা দূরে অতি,
যন্ত্রের জেলে ফেঁসেছে অম্লজান।

পশু হত্যার দরকারি হাতিয়ার
উন্নত হয়ে ফিরেছে নিজের দিকে।
কোথায় মানুষ? কোথা বসবাস তার?
শুধু মানুষের উপমাই আছে টিকে।

হাতে নিয়ে অক্‌সিজেনের নল,
নিজের রসেই সভ্যতা রসাতল।।

(২৫.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৮.
রাজা বাহাদুর নিয়ম দিয়েছে ফেঁদে,
অনুমতি ছাড়া শরাব যাবে না ছোঁয়া।
প্রেমিক কবিটি এই ফ্যারে গেছি বেঁধে,
জঞ্জাল জমে, হয় না মগজ ধোয়া।

অনুমতি পেতে অর্থের প্রয়োজন,
ভাগ্যের গুনে লক্ষী হয় না সাথি।
কিভাবে সাধন করি এই আয়োজন?
আমিটি তো নই জগৎ শেঠের নাতি।

মাঝে সাজে কিছু ধার-হাওলাত পেলে,
ভাবি অনুমতি নিয়ে নেবো এইবারে।
কিন্তু দিনের সন্ধাটি নেমে এলে,
ঢুকে পড়ি সোজা গেলাশের দরবারে।

কিভাবে আমার অনুমতিখান জোটে?
টাকা পেলেই তো গেলাশ ছোঁয়াই ঠোঁটে।।

(২৮.০৬.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

৯.
বড়ো সাধ হয় পাখিদের মত উড়ি,
মৃত্তিকাসংলগ্ন মানবদেহ
নিতান্ত এক দুরাশায় একা পুড়ি।
আমার স্বপ্ন শরিক থাকে না কেহ-

কেউ হেসে ভাবে কড়া তামাকের ঘোর,
ফতুর মগজ গেঁজিয়ে গিয়েছে দেখি।
সরল তরলে রাত পার কোরে ভোর।
হেসে কোরে যায় প্রভাতকালীন রেকি।

কেউ বিমানের প্রসঙ্গ তুলে বলেঃ
বিকল্প ডানা আছে তো উড্ডয়নে,
চ’ড়ে বসো সেই নভোজাগতিক কলে।
কিবা লাভ বলো ফালতু স্বপ্নয়নে?

আমি তো পেয়েছি খুঁজে উড়বার ডানা,
তাই শুধু শুনি, হয়ে থাকি বোবা, কানা।।

(০৭.০৭.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

১০.
লাশ হয়ে যাই লোহার বাসরঘরে,
পাশে নাগরিক বেহুলা রয়েছে শোয়া।
এখনো রাত্রি রয়ে গেছে এক পোয়া,
আবাজ ফেটেনি পাখির কণ্ঠস্বরে।

পরের ঘটনা সিনেমার অনুরূপ-
চক্ষু মটকে নিহত শক্ত স্বামী,
ক্রন্দনরত বধূটি ও তার মামী,
বাকিরা নিরব, শোকে বিলকুল চুপ।

কলার ভেলার বিকল্প হলো ট্রাক,
বেহুলা ভাসায় ছয়টি চাকার ভেলা।
পিচের নদীতে ভেসে চলি সারাবেলা,
পাশ দিয়ে ছোটে তাজা স্বপ্নের ঝাঁক।

দেবতা-সভায় পৌঁছে লক্ষ্য করি,
একাকি এসেছি সাথে নেই সুন্দরী।।

(২৮.০৭.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

১১.
চোখের কোনায় জমা জল, না পিচুটি?
এই প্রশ্ন মনে হলো এখানে এসেই।
নদী এক বয়ে গেছে শহর ঘেঁষেই,
খোলা মাঠ দিগন্তরে দিয়ে দিছে ছুটি।

হাওড় বাওড় জল খুব চেনা নয়,
আমার শ্রোনিতে আছে অরন্যের স্মৃতি,
জোয়ারের ভরা নদী বিপুল বিস্তৃতি।
প্রাচীন মাটির ঘ্রান এখানে ঘুমায়-

চোখের কোনায় আজ জমেছে পিচুটি,
চোখের কোনায় জমা হয়ে আছে জল।
আমাদের বৃক্ষশাখে নেই কোনো ফল,
গোপন দাবার চালে হয়ে গেছি খুঁটি।

জমিন, আকাশ, স্বপ্ন, ক্ষেতের ফসল,
কিছু নেই, সুদ গুনি- পাই না আসল।।

(২২.০৭.১৯৯৭ ফেরিঘাট ময়মনসিংহ)

১২.
ভরা ভাদ্রের ঠাটানো দুপুরবেলা,
একা বোসে আছি ভাবনার ছিপ ফেলে।
যেন আমি এক পরাবাস্তব জেলে,
পেতেছি মগজে জল-বড়শির খেলা।

খুব মনোযোগে ফাতনায় রাখি চোখ,
ঠোক দিয়ে যায় চিন্তার চুনোপুটি।
মগজের জলে মাকড়ের ছোটাছুটি,
উল্লাস করে নষ্ট পানির পোক।

রুই কাতলার খবর হয় না কোনো
মৃদু সমিরনে ফাতনাটি কাঁপে শুধু।
ঢেউ-খেলা-জল চারিপাশে করে ধু-ধু,
নিবিড় আবেগে প্রত্যাশা হয় ঘন।

আমি কি তাহলে নিভৃত চণ্ডীদাস!
কিসের আশায় হয়ে আছি কার দাস??

(০৬.০৮.১৯৯৭ বাবুপুরা ঢাকা)

১৩.
সহসাই দেখি মন্দির ঘিরে আছে
টুপিয়ালা মাথা অজস্র মারমুখি,
আল্লার নামে ভাঙচুরে লেগে গেছে।
আর ভীত টিকি সোজা ভগবানমুখি-

উভয়ে তো বেশ শান্তির কথা বলে,
পুরান কেতাবে দেখেছি সে সব পড়ে।
এখন দেখছি ঘনঘোর কুতুহলে,
ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে অন্যের ঘাড়ে।

বস্তু দেখছি মিলিয়েছে বিশ্বাসে,
রক্তারক্তি লুটপাট সোনাদানা।
তর্ককারিরা দূরে বোসে মৃদু হাসে,
বিশ্বাসকারি দেবালয়ে দেয় হানা।।

দেখে ধর্মের পূত-খোমা-মোবারক,
দুরে সরে আছি হয়ে এক ধ্যানি বক।।

(০৭.০৮.১৯৯৭ বাবুপুরা ঢাকা)

১৪.
পরশপাথর কখনো যায়নি পাওয়া
পাওয়া গেছে শুধু পরশিত সোনা-প্রস্তর।
স্বপ্নদিঘিতে সারারাত নাও বাওয়া
একাকি চাঁদের একাকি স্বপ্নগ্ৰস্তর।

খুলে ফ্যালো আলখেল্লোর অস্বস্তি
প্রপিতামহের প্রথা বিপরীত সরলতা।
বুলডোজারের নিচে সমাহিত বস্তি,
কংক্রিটে ফোটে মানব-স্বভাবি তরুলতা।

শিকড়ের মূলে তক্ষক করে ইশারা
ত্বকে খুঁজে পাই শ্যামল সুখের গৌরব।
ছোঁয়া চুম্বন আদোর হয়েছে কি সারা?
নিরব নাভিতে জাগে নৈবুপাতা সৌরভ।

এই ফাল্গুনে তরুন ফুলের মতো,
নিয়েছি সুবাস বিলাবার মৃদু ব্রত।।

(০৯.১১.১৯৯৭ বাকুশা ঢাকা)

১৫.
পা পিছলে যেই পড়েছি তোমার প্রেমে,
ওমনি প্রকৃতি পাল্টালো ঋতু-জামা।
দখিনা বাতাস নিসর্গে ঘ’ষে ঝামা
কুয়াশা-শ্যাওলা ওঠাতে উঠলো ঘেমে।

হিচ্ড়ে পিচ্ড়ে হাতড়াই চারপাশ,
কিছু ধরে যদি অন্তত কিছুখন
ঝুলে থাকা যায়, পতিত বেকুব মন
খোঁজে আতিপাতি আপাতত আশ্বাস।

শুনেছি অনেক প্রেমে পতনের সুখ,
আকুলি-বিকুলি নানা প্রশস্তি কথা।
অবিশ্বাস্য, মিছে সব, রূপকথা-
সুখেরা নিছক ঢেকে আছে প্রিয় মুখ।

ভাগ্যিস পা-টা পিছলে গেলেও শেষে,
টিকে আছি পদ-পদ্মকে ভালোবেসে।।

(২১.১১.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

১৬.
প্রতিশ্রুতি পতাকার মতো ওড়ে ওই,
নিসর্গের হিয়া সাক্ষী জনতার হাত,
দিতে হবে রাত্রি ছিড়ে স্বাধীন প্রভাত-
অঙ্গিকার ভঙ্গ তুমি করো না নিশ্চই।

রক্তের কালিতে লেখা বিজয়ের গান,
ভুলে গেলে ঝলসাবে বুকের আগুন।
কুমারীর গর্ভে ফের জন্ম নেবে ভ্রূণ,
নিমেষে সাবাড় হবে সুখের বাগান।

কয়জনে ছুঁতে পারে সাপের মাথায়
সাবধানে রেখে দেয়া অমূল্য মানিক।
সাহস সাহসী হয়ে জয়মাল্য নিক,
কারুকাজ তোললা তুমি কালের কাঁথায়-

আমাদের সুরে গান গলায় ধরো না,
অঙ্গিকার ভঙ্গ তুমি নিশ্চই করো না।।

(০৬.১২.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)

১৭.
নিখিল দিয়েছিলো নরক-নগ্নতা,
আমার চোখে ছিলো অমলিন দৃষ্টি।
হৃদয় ছুঁয়েছিলো মেঘের মগ্নতা,
তবুও ঝরলো না প্রার্থিত বৃষ্টি।

গুটিয়ে নিলে হাত, আঙুল সোনালিমা,
ফোটালে পাথরের বুক জুড়ে কান্না।
সহসাই কণ্ঠে নেমে এলো কালিমা,
ঝ’রে গেলো মাটিতে আলোকিত পান্না।

আলতো ছুঁয়ে গেলে, এমন কুয়াশায়
আশায় বাধে ঘর হলুদাভ রাত্রি।
জোস্না-পাতা ঝ’রে মাটিতে শিহরায়
উদাসি প্রান্তর উদাসিন যাত্রি।

এখনো আলো আসে জানালা খোলা রাখি,
পেছন গান গায় খাঁচায় পোষা পাখি।।

(২০.১২.১৯৯৭ রাজাবাজার ঢাকা)