বন্যাদায়

দামোদরের উদরে আজ একী ক্ষুধা সর্বগ্রাসী!
বাঁধ ভেঙে, হায়, হন্য হয়ে বন্যা এল সর্ব্বনাশী।
রাঙামাটির মুলুকে আর রাঙামাটির নেই নিশানা,
চারিদিকে অকুল পাথার- চারিদিকে জলের হানা।
দেউলগুলোর দুয়োর ভেঙ্গে ঢেউ ঢুকেছে হল্লা ক’রে-
পয়সা নিতে পাণ্ডা-পুরুং দাঁড়ায়নি কেউ কবাট ধ’রে।
নীচু হওয়ার নানান্ দুখ- খুলে কি আর বল্ব বেশী-
বর্ষা হল কোন্ পাহাড়ে- ডুব্ল নাবাল্ বাংলা দেশই।

এ দামোদর গোবিন্দ নয়;- গো-ব্রাহ্মণের নয় এ মিতে-
হাজার গরু ডুবিয়ে মারে,- ধ্বংস করে হর্ষচিতে!
জগৎহিতের ধার ধারে না, অন্ধ অধীর অকুল-ধারা,
আপন ধর্ম্মে ধায় সে শুধু ক্রুদ্ধ যমের মহিষ পারা;
এই মহিষের বাঁকা দু’শিং-তা’তে আকাল মড়ক বসে,
চুসিয়ে চলে ডাইনে বামে, সোনার দেশের পাঁজর খসে!
এ দামোদর গোবিন্দ নয়- সৃষ্টি যেজন পালন করে;
লম্বোদরী জন্তলা এ গজ গিলেছে দম্ভভরে!

মুছে গেছে গ্রামের চিহ্ন, চেটে নেছে ভিটের মাটি;
মরণ-টানে টান্ছে ডুরি,- সাতটা জেলায় কান্নাকাটি।
ধনে প্রাণে ঢের গিয়েছে- হিসাব তাহার কেউ জানে না।
ছন্দছাড়া, বন্ধুহারা,- ঘরে তাদের কেউ আনে না।
আল্গা চালার কাছিম-পিঠে যাচ্ছে ভেসে কেউ পাথারে,
পুড়্ছে রোদে উপবাসী, ভিজ্ছে মুষলবৃষ্টিধারে;
হারিয়েছে কেউ পুত্র কন্যা, হারিয়েছে কেউ বৃদ্ধ মায়,
আজকে আধা বাংলা দেশে ঘরে ঘরে বন্যাদায়।

অন্ধ, বুড়া, পঙ্গু কত পালিয়ে যাবার পায়নি দিশা,
কত শিশুর জীবন-ঊষায় এসেছে হায় অকাল-নিশা;
কত নারী বিধবা আজ, অনাথ কত সদ্য-বধূ!
কত যুবার অস্বাদিত রইল জগৎ-ফুলের মধু।
বর-ক’নেতে ভাস্ছে জলে হলুদ-বরণ সুতা হাতে
ফুল-সেজে কার কাল এসেছে- বান এসেছে বিয়ের রাতে।
জল ঢুকেছে সাত শো গাঁয়ে, হাজার-ফোকর মৌচাকেতে।
ধুয়ে গেছে মধুর ধারা, সঞ্চিত আর নাইক খেতে।

বট-পাকুড়ের ফেঁক্ড়িগুলো অবশ হাতে পাক্ড়ে ধ’রে
কত লোক আজ কষ্টে কাটায় সাপের সঙ্গে বসত ক’রে।
অবাক্ হয়ে রয়েছে সব অসম্ভবের আবির্ভাবে,
সত্য স্বপন গুলিয়ে গেছে,- কেবল আকাশ-পাতাল ভাবে।
হাল্ পুছিলে জবাব দিতে কেঁদে ফেলে শিশুর মত,
হারিয়ে মানুষ হারিয়ে পুঁজি গরীব চাষা বুদ্ধিহত।
ভিক্ষা এদের ব্যবসা নহে,- হাত পাতিতে লজ্জা পায়,
দৈবে এরা ভিক্ষাজীবী,- আজকে এদের বন্যাদায়।

বানের জলে দুধের ছেলে তক্তপোষের নৌকা চ’ড়ে
ভেসে ভেসে এল এল কোন্ গাঁ হতে জলের তোড়ে।
তুলতে ধ’রে ঠেকল্ ভারি তক্তপোষের একটি পায়া,
আঁক্ড়ে পায় জলের তলে মরা মায়ের অমর মায়া!
লুপ্ত আজি পীযূষধারা মত্যুহত মায়ের বুকে,
দুধের ছেলে ক্ষুধা পেলে কে দেবে দুধ শুষ্ক মুখে?
এক রাতে যার স্নেহের দুলাল হ’ল পথের কাঙাল হায়,
কে দেবে তায় মায়ের স্নেহ? আজ অভাগার বন্যাদায়।

বানের মুখে সাঁতার টেনে আতুর স্বামীর প্রাণ বাঁচায়ে,
ডাঙায় তুলে কোলের ছেলে, সাঁৎরে যে ফের ফির্ল গাঁয়ে
বাঁধা গরুর খুলতে বাঁধন, তুল্তে নিজের ক্ষুদ্র পুঁজি,
ফিরতে সে আর পারেনি হায় বন্যাজলের সঙ্গে যুঝি’;
নেই বেঁচে সে চাষার মেয়ে দুঃসাহসী দয়াবতী,
আছে তাহার কোলের ছেলে, আছে তাহার আতুর পতি;
তাদের কে আজ পথ্য দেবে- আজকে তারা নিঃসহায়,
হাতে হাতে মিলিয়ে নে ভাই, আজ আমাদের বন্যাদায়।

আসল গেছে, ফসল গেছে, গেছে দেশের মুখের ভাত;
সামনে ‘পূজো’- নতুন ধুতির সঙ্গে ভাসে তাতীর তাঁত।
কোথায় গেছে হালের বলদ, কোথায় গেছে দুধের গাই,
কার ভিটেতে কে মরেছে,- কিছুরই খোঁজ খবর নাই।
উদাসী আজ কাজের মানুষ সকল-শূন্য-হওয়ার শোকে,
শুন্ছে না সে কিছুই কানে, দেখ্ছে না সে কিছুই চোখে;
দেশের যারা পুষ্টি কান্তি সেই চাষীদের পানে চাও,
বন্যাদায়ে নিঃসহায়ে ভিক্ষা দাও গো ভিক্ষা দাও।

অনুজ সমান ছাত্রেরা আজ অগ্রজেরি কাৰ্য্য করে,-
দেশের কাজে অগ্রে চলে- স্বেচ্ছাসেবার দুঃখ বরে।
আজ্কে কে যেন প্রলয়-বুকে সুপ্ত জ্যোতির্লেখা হাসে
ক্ষুদ্র দানের বটের পাতায় ভাবী দিনের ইষ্ট ভাসে;
দুঃখীরূপে দুঃখহারী আজ আমাদের নেবেন সেবা,
দুন্দুভি তাঁর উঠ্ল বেজে, না যাবে আজ এগিয়ে কেবা!
সৰ্ব্বভূতের অন্তরাত্মা আজকে শোনো উঠ্ছে কেঁদে;
বধির হ’য়ে থাক্বে কে আজ ব্যর্থ জীবন বক্ষে বেঁধে?
এ দায় নহে ব্যক্তিগত-যেমন-ধারা কন্যাদায়,
বাংলা জুড়ে রোল উঠেছে- আজ আমাদের বন্যাদায়।

আছেন দেশে দুঃখহারী লক্ষদাতা কোটীশ্বর,
তাঁদের পুণ্যে লক্ষ প্রাণী দেখ্বে ফিরে সুবৎসর,
কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়- সপ্ত কোটির এদেশটিতে।
ভর্তে হবে ভিক্ষাপাত্র ক্ষুদ্র দানের সমষ্টিতে।
শাকান্নের যে দু’এক কণা বাঁচে তোমার আমার ঘরে-
নিবেদিয়া দাও তা আজি নারায়ণের তৃপ্তি তরে!
তুষ্টিতে তার জগৎ তুষ্ট- দুর্ব্বাসারও ক্ষুধা হরে,
তার নামে দাও মুষ্টিভিক্ষা, জয় হবে দুর্ভিক্ষ-‘পরে।
গরীব-সেবাই হরির সেবা- ভারতবাসী ভুল্ছ তাও?
বন্যাদায়ে নিঃসহায়ে ভিক্ষা দাও গো ভিক্ষা দাও।

মরুভূমির মানুষ যারা- মরা জলের দেশে থাকে-
তাদেরও প্রাণ সরস আজি- মরম বোঝে, ধরম রাখে;
তারাও আজি মর্ত্তে বসি’ চিত্ত-আরাম-স্বর্গ লভে,
দুঃস্থ শিরে ভগবানের ছত্র ধরে সগৌরবে।
সার্থকতা দ্বারে তোমার, বন্ধ কর ব্যর্থ কথা,
মরম দিয়ে মরম বোঝ ঘুচাও মনের দরিদ্রতা;
ঘুচাও কুণ্ঠা ওগো বন্ধু! শক্তি কারো তুচ্ছ নয়,
হিম হতে যে বাষ্প লঘু,- তাতেই বাদল বন্যা হয়।
যুগে যুগে পুণ্য খোঁজ,- পুণ্য আজি তোমায় চায়,
শূন্য হাতে ফিরিয়ে না গো; রক্ষা কর বন্যাদায়।