বড়দিনে

তোমার শুভ জন্মদিনে প্রাণাম তোমায় কর্ছে অখৃষ্টান,
ভগবানের ভক্ত ছেলে! ঋষির ঋষি! খৃষ্ট মহাপ্রাণ!
সাত মনীষীর বন্দনীয় ওগো রাখাল! ওগো দীনের দীন!
জগৎ সারা চিত্ত দিয়ে স্বীকার করে তোমার কাছে ঋণ।
হৃদয়-লতার তন্তু দিয়ে বিশ্ব সাথে বাঁধলে বিধাতারে,
পিতা ব’লে ডাক্লে তাঁরে আনন্দেরি সহজ অধিকারে।
চম্কে যেন উঠল জগৎ নূতনতর তোমার সম্বোধনে;
শাস্ত্রপাঠী উঠল রুষে, শয়তানের ফন্দী আঁটে মনে;
টিট্কারী দ্যায় সন্দেহীরা ভাবে বুঝি দাবী তোমার ফাঁকা,
ক্রুসের পরে জীবন দিয়ে রক্তে আপন কর্লে দলীল পাকা।
মৃত্যুপারের অন্ধকারে ফুট্ল আলো, উঠল যে জয়গান,
আপনি মরে বিশ্ব-নরে দিলে তুমি নবজীবন দান।
স্বর্গে মর্ত্তে বাঁধলে সেতু, ধন্য ধরা তোমার আবির্ভাবে।
মরণ-জয়ী দীক্ষা তোমার জায়াজয়ে অটল লাভালাভে।
* * *
তাই তো তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন,
স্বরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান্ চিত্ত স্বার্থলীন;
আমরা তোমায় ভালবাসি, ভক্তি করি আমরা অখৃষ্টান,
তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এসিয়ার, আছে নাড়ীর টান,
মস্ত দেশের ক্ষুদ্র মানুষ আমরা, তোমায় দেখি অবাক্ হ’য়ে,
অশেষ প্রকার অধীনতার ক্রুসের কাঁটা সারা জীবন স’য়ে।
রাষ্ট্র মোদের কাঁটার মুকুট, সমাজ মোদের কাঁটার শয্যা সে যে,
যতই ব্যথায় পাশ ফিরি হায় ততই বেঁধে, ততই ওঠে বেজে!
কাণ্ডারীহীন জীবন-যাত্রা, কুকাণ্ড তাই উঠছে কেবল বেড়ে,
যোগ্যতম জবর্দস্তি ফেলছে চ’ষে জগৎটা শিং নেড়ে!
নৃশংসতার হূণ অতিহূণ টেক্কা দিয়ে চল্ছে পরস্পরে,
শয়তানী সে অট্টহাসে সত্য-বাণীর কণ্ঠ চেপে ধরে!
গির্জ্জা-ভাঙা হাউইট্জারের গর্জ্জনে হায় ধর্ম্ম গেল তল,
মাৎ হ’য়ে যায় মনুষ্যত্ব, ‘কিস্তি’ হাঁকে ভব্য ঠগীর দল।
নিরীহ জন লাঞ্ছনা সয়, সে লাঞ্ছনা বাজে তোমার বুকে,
নিত্য নূতন ক্রুসের কাঠে তোমায় ওরা বিঁধছে পেরেক ঠুকে।

তোমার ‘পরে জুলুম ক’রে ক্ষুন্ন ক’রে মনুষ্যত্বধারা
রোমের হুকুম-মহকুমা গুঁড়িয়ে গেল, ধূলায় হ’ল হারা।
আজ বিপরীত-বুদ্ধি-বশে ভুল্ছে মানুষ ভুলছে কালের বাণী,
তাসের পরে তাস সাজিয়ে ভাবছে হ’ল অটল বা রাজধানী।
মাড়িয়ে মানুষ উড়িয়ে ধূলো অন্ধ বেগে কবন্ধ রথ চলে,
ওষ্ঠবাসী খৃষ্ট-ভক্তি ডুবছে নিতি নীট্শেবাদের তলে!
তাকায় জগৎ বাক্যহারা ইয়োরোপের মাটির ক্ষুধা দেখে,
ভব্যতা সে ভির্ম্মি গেছে ভেপসে-ওঠ টাকার গেঁজেয় থেকে,
উবে গেছে ভক্তি শ্রদ্ধা, শিষ্টতা আড়ষ্ট হ’য়ে আছে,
জড়বাদের স্কন্ধে চ’ড়ে ধিঙ্গি-পারা জিঙ্গো-জুজু নাচে!
তিন ডাকিনী নৃত্য করে ইয়োরোপের শ্মশান-পারা বুকে-
লড়াই-লালচ, বড়াই-লালচ, কড়ির-লালচ,- নাচছে বিষম রুখে।
ওখানে ঠাঁই নাই প্রভু আর, এই এসিয়ায় দাঁড়াও স’রে এসে-
বৃদ্ধ-জনক-কবীর-নানক-নিমাই-নিতাই শুক-সনকের দেশে;
ভাব-সাধনার এই ভুবনে এস তোমার নূতন বাণী ল’য়ে,
বিরাজ করো ভারত-হিয়ার ভক্তমালে নূতন মণি হ’য়ে;
ব্যথা-ভরা চিত্ত মোদের, খানিক ব্যথা ভুল্বে তোমায় হেরি;
সত্য-সাধন-নিষ্ঠ শিখাও, বাজাও গভীর উদ্বোধনের ভেরী;
ধৈর্য্যগুঢ় বীর্য্য তোমার জাগুক, প্রাণের সব ভীরুতা দহি’,
সহিষ্ণুতায় জিষ্ণু করো, মহামহিম আদিম সত্যগ্রহী!
নিগ্রহে কি নির্য্যাতনে ফুরিয়ে যেন ন যায় মনের বল।
নিত্য-জীবন-লাভের পথে জাগুক তোমার মূর্ত্তি অচঞ্চল!
পরের মরম বুঝতে শিখাও, হে প্রেমগুরু, চিত্তে এস নেমে,
কুষ্ঠ-ক্লেদের মাঝখানে ভার দাও হে সেবার সর্ব্বসহা প্রেমে;
মন নিতে চায় ওই আদর্শ, নাগাল না পাই, হাত ধ’রে নাও তুমি,
মরে অমর হবার মতন দাও শকতি দীনের শরণভূমি!
সবল কর পঙ্গু ইচ্ছা, পরশ বুলাও মনের পক্ষাঘাতে,
হাত ধ’রে নাও, পৌঁছিয়ে দাও সত্যি-বাঁচার নিত্য-সুপ্রভাতে।
বিশ্বাসে যে বল অমিত সেই অমৃতের দরজা দাও খুলে,
অভয়-দাতা! পৌঁছিয়ে দাও পরম-অন্নদাতার চরণ-মূলে!
ব্যথার বিষে মন ঝিমালে স্মরি যেন তোমার মশান-গীতা-
“না গো আমায় ত্যাগ করো না, ত্যাগ করো না,
পিতা! আমার পিতা।”