গিরিরাণী

আধার ঘরে বরষ পরে উমা আমার আসে,
চোখের জলে তবু এমন চোখ কেন গো ভাসে?
শরৎ-চাঁদের অমল আলোয় হাসে উমার হাসি,
জাগায় মনে উমার পরশ শিউলি-ফুলের রাশি;
উমার পায়ের আভা দেখি সকাল-বেলার রোদে,
দেখতে দেখতে সারা আকাশ নয়ন কেন মোদে!
উৎসুকী মন হঠাৎ যেন উদাস হয়ে পড়ে,
শরৎ-আলোর প্রাণ উড়ে যায় অকাল মেঘের ঝড়ে
বরণ-ডালার আলোর মালার সকল শিখা কাপে;
রোদন-ভরা বোধন-বেলা; বুক যে ব্যথায় চাপে।
উদাস হাওয়া হঠাৎ আমার মন টানে কণর পানে,
হাসির আভাস যায় ডুবে হয় নয়ন-জলের বানে।
বছর পরে আসছে উমা বাজ ল না মোর শাখ,
উম এল; হায় গিরিবর, কই এল মৈনাক?

* * *

কই এল বীর পুত্র আমার, কই সে অভয়ব্ৰতী,
অত্যাচারের মিথ্যাচারের শত্রু উদারমতি;
কাটুতে পাখী পারেনি যার বজ তীক্ষুধার;
পাখন মেলে মায়ের কোলে আসবেন সে আর?
বিধির দত্ত বিভূতি যে রাখলে অটুটু একা,-
নিৰ্ব্বাসনে করলে বরণ,- পাব না তার দেখা?
সে বিনা, হায়, শূন্ত হৃদয়, শূন্ত এ মোর ঘর,
ছিন্নপাথ শৈলকুলের কই সে পক্ষধর?
আজ্কে সে হায় লুকিয়ে বেড়ায় কোন্ সাগরের তলে,
মাথার পরে আট পহরে কী তার তুফান চলে!
হারিয়েছে সে স্বৈরগতি, অব্যাহতি নাই,
স্বভাব-স্বাধীন কাটায় যে দিন বন্ধনে একঠাই।
কন্যা দিয়ে দেবতা জামাই বেঁধেছিলাম আমি,
কি ফল হ’ল? চোখের জলে কাটাই দিবসযামী।
‘দেবাদিদেব’ কয় লোকে তায়, কেউ বলে তায় ‘শিব’,-
তাঁর বরে হায় হ’ল মোদের ব্যথাই চিরঞ্জীব!
যম-যাতন হ’ল স্থায়ী শিবকে জামাই পেয়ে,
সোঁৎ বছরে তিনটি দিনের অতিথ্ হ’ল মেয়ে;
ছেলে হ’ল পর-চেয়ে দূর- এ দুখ কারে কই?
হারিয়ে ছেলে হারিয়ে মেয়ে শূন্ত ঘরে রই।
উমার বিয়ের রাত থেকে আর সোয়াস্তি নেই মনে,
রাত্রি দিনে জল না শুকায় এ মোর দু’নয়নে!

* * *

মৈনাকেরি মৌন শোকে মন যে ম্রিয়মাণ;
বোধন-বেলার সানাই বাজে,- কাদে আমার প্রাণ।
কতদিনের কত কথা মনের আগে আসে,
জলে-ছাওয়া ঝাপসা চোখে স্বপ্ন সমান ভাসে।
মনে পড়ে মোর আঙ্গিনায় বর-বিদায়ের রথ,
সার দিয়ে খান ‘সু-কৃতি’ ভোজ তিন কোটি পৰ্ব্বত।
ভোজের শেষে হঠাৎ এসে খবর দিল চরে,-
“হেম-সুমেরুর হৈমচুড়া ইন্দ্র হরণ করে!”
উঠল রুষে বজ্রললাট শৈল কুলাচল,
পড়ল ডঙ্ক যুদ্ধ লাগি’, তিনকোটি চঞ্চল!’
বিদায় ক’রে গৌরী-হরে মন্ত্রণ সব করে
বাদল ঘেরা মেঘের ডেরা মেঘ-মণ্ডল ঘরে।
“বিধাতারে জানাও নালিস” স্থাবর গিরি কয়,
কেউ বলে “বৈকুণ্ঠে জানাও!” লাখ বলে “নয় নয়,
কঁদিতে মানের কান্না যেতে চাইনে কারু কাছে,
ইজ্জতে ভাই রাখতে বজায় বল বাহুতেই আছে।
কর্ব যুদ্ধ, নেইক শ্রদ্ধা আর বাসবের পরে,
পাশব বলে বলী বাসব বুঝেছি অন্তরে।”
হঠাৎ শুনি নারদ মুনি আসেন দ্রুতপায়,
যুদ্ধ স্থসাব্যস্ত হ’ল মুনির মন্ত্রণায়!

* * *

আজো যেন শুনছি কানে হাজার গলার মধ্যে থেকে,
মৈনাকেরি কিশোর কণ্ঠ ছাপিয়ে সবায় উঠ্ছে জেগে;
বলছে তেজী “কিসের শান্তি? চাইনে শান্তি স্পষ্ট কহি,
দেবতা হ’লে দস্যু কি চোর আমরা হব দেবদ্রোহী।
সুমেরু কোন্ দোষের দোষী? সৰ্ব্বভূতের হিতৈষী সে।
ইন্দ্র যে তার নিলেন সোনা- ন্যায় আচরণ বল্ব কিসে?
দেব্তা হলেও চোর অমরেশ, হরণ তিনি করেন ছলে,
‘বৃহৎ চৌর্য্য প্রায় সে শৌর্য্য’- এমন কথা চোরেই বলে,
কিম্বা বলে তারাই যারা বিভীষিকায় ভক্তি করে-
চোর সে যদি হয় জোরালো তারেই পূজে শ্রদ্ধা-ভরে।
শ্রদ্ধেয় সে নয়কো জানি আমরা শ্রদ্ধা করব না তায়,
স্বৰ্গপতির বজ্রভয়ে মাথা নত করব না পায়;
হেম-সুমেরুর হৃত সোনা দেবো নাকে হজম হ’তে,
পাহাড় মোরা তিন কোটি ভাই করব লড়াই বিধিমতে।”

* * *

আকাশ জুড়ে বিপুলবপু উড়ল পাহাড় ক্রোর-
ধরার উপগ্রহের মালা উল্কা হেন ঘোর!
অন্ধ ক’রে সূৰ্য্য ওড়ে বিন্ধ্য বসুমান,
ধবল-গিরির ধবলিমায় চন্দ্রমা সে ম্লান;
তীর-বেগে ধায় ক্ৰৌঞ্চপাহাড় ক্ৰৌঞ্চ-কুলের সাধ,
নীল-গিরি নীলকান্তমণির নিৰ্ম্মিত ঠিক চাঁদ;
উদয়গিরি অস্তগিরি উড়্ল একত্তর,
মাল্যবান্ আর মলয়গিরি ছায় নভ-চত্বর;
চন্দ্রশেখর সঙ্গে মহা-মহেন্দ্র পৰ্ব্বত-
লোমকূপে লাখ ঋষি নিয়ে উড়্ল যুগপৎ!
সবার আগে চলল বেগে শৈল-যুবরাজ
মৈনাক মোর;- ফেল্তে মুছে শৈলকুলের লাজ।

* * *

আজো আমি দেখ্ছি যেন দেখ্ছি চোখের ‘পর
দিকে দিকে দিক্পালের লড়্ছে ভয়ঙ্কর!
মেঘের বরণ মহিষ-বাহন যুদ্ধ করেন যম,
অগ্নি যোঝেন রক্তচক্ষু নিঃস্নেহ নিৰ্ম্মম।
চোরাই সোনার কুমীর হোথা লড়েন কুবের বীর-
সাজোয়া সোনার, সোনার খাড়া, সোনার ধনুক তীর।
পবন লড়েন উড়িয়ে ধূলো অন্ধ ক’রে চোখ,
নিঋতি নীল বিষ-প্লাবনে ধ্বংসিয়ে তিন লোক।
স্বষ্টিনাশ যুদ্ধ চলে, আৰ্ত্ত চরাচর,
আচম্বিতে দিগ্বারণে আসেন পুরন্দর।
হেঁকে বলে বজকণ্ঠে মাহুত মাতলি-
“প্রলয়বাদী তোমরা পাহাড় নেহাৎ বাতুলই।
বিধির স্থষ্টি কর্বে নষ্ট? এই কি মনের আশ?
বিপ্লবে সব ডুবিয়ে দেবে? করবে সৰ্ব্বনাশ?
ইন্দ্র-দেবের শাসন-প্রথার করবে অমান্য?-
প্রতিষ্ঠা যার বজ্রে,- ও যা পরম প্রামাণ্য?”
রুষ্টভাষে কয় আকাশে মহেন্দ্ৰ পৰ্ব্বত,-
“চোরের উকীল। আমরা মন্দ, তোমরা সবাই সৎ!
লোভান্ধ ওই ইন্দ্র তোমার হরেন পরের ধন,
পরের সোনা হজম ক’রে করেন আস্ফালন।
বৃহৎ চোরের আস্ফালনে টল্ছে না পাহাড়,
ধৰ্ম্মনাশা ধৰ্ম্ম শোনান্ যায় জ্ব’লে যায় হাড়!
পরস্ব নিশ্চিন্ত মনে, ইন্দ্র, কর ভোগ,
তার প্রতিবাদ কর্লে রোষো- এ যে বিষম রোগ!
যার ধন তার ভারি কসুর, ফিরিয়ে নিতে চায়,
বিপ্লবের আর বাকী কিসে?- বজ হানা যায়!
আর তবে বিলম্ব কেন? বজ্র হানো বীর।
তাড়শে সাম্রাজ্য-পদের গৰ্ব্বে বাঁকা শির!
বিধান-কর্ত্তা! বিধান ভাঙো, জানাও আবার রোষ,
তোমার কসুর নয়, সে কিছুই, পরের বেলাই দোষ।
নেই মোটে ন্যায়ধৰ্ম্ম কিছুই, ছল আছে আর জোর,
বল্ছি স্পষ্ট, ইন্দ্র নষ্ট, ইন্দ্র সবল চোর!”

* * *

হঠাৎ গ’র্জে উঠ্ল বজ্র ঝল্সিয়ে ব্যোম্পথ,
পড়ল মৰ্ত্ত্যে ছিন্নপাখা মহেন্দ্ৰ পৰ্ব্বত।
পড়্ল বিন্ধ্য যোজন জুড়ে, পড়্ল গোবৰ্দ্ধন,
হারিয়ে গতি পঙ্গু পাহাড় পড়্ল অগণন,
গ্ৰহতারার মতন যারা ফির্ত গো স্বাধীন
গরুড় সম অসঙ্কোচে ফির্ত নিশিদিন
অচল হ’তে দেখ্ল তাদের, আমার দু’নয়ন;
দেখার বাকী ছিল তবু, তাই হ’ল দৰ্শন-
হর্ষ-বিষাদ মাখা ছবি- বীরত্ব পুত্রের-
উদ্যত বজ্রাগ্নি-আগে দীপ্তি সেই মুখের।
ঐরাবতের মাথায় হেনে পাষাণ করবাল
শ্যেনের বেগে ডুব্ল জলে আমার সে দুলাল!
বজ্র নাগাল পেলে না তার,- মিলিয়ে গেল কোথা,
মূৰ্ছা-শেষে দেখ্নু কেবল বয় সাগরের সোঁতা!

* * *

সেই অবধি চোখের আড়াল, চোখের মণি পর;
পাখনা দুটো যায়নি কাটা এই যা সুখবর।
হ্যায়-ধরমের মর্য্যাদা মান রাখ্তে গেল যারা
হার মেনে হয় লাঞ্ছনা সয়, হেঁটমুখে রয় তারা!
ইন্দ্র নিলেন পরের সোনা- সেই করমের ফলে
আমার মাণিক হারিয়ে গেল অতল সিন্ধুজলে।
কুক্ষণে কার হয় কুমতি রোয় সে বিষের লতা,
ফল খেয়ে তার পান্থপাখী লোটায় যথাতথা।
কোথায় পাপের সূত্ৰ হ’ল- উঠ্ল ঝোড়ে হাওয়া,-
দিন-মজুরের উড়্ল কুঁড়ে বুকের বলে ছাওয়া।
কোথায় লোভের ঘৃণ্য শোলুই জন্মাল কার মনে,-
সাপ হ’য়ে সে জড়িয়ে দিল লোক্সানে কোন্ জনে!
ডুবে গেলাম, ডুবে গেলাম, ডুবে গেলাম আমি,
নয়নজলের নুন-পাথরে তলিয়ে দিবস-যামী।

* * *

সবে আমার একটি মেয়ে, শ্মশানে তার ঘর;
ছেলেও আমার একটি সবে, তাও সে দেশান্তর,
লুকিয়ে বেড়ায় চোরের মতন বড় চোরের ভয়ে।
কেমন আছে? কে দেবে তার খবর আবার ক’য়ে?
হাওয়ার মুখেও বাৰ্ত্তা না পাই ইন্দ্রদেবের দাপে;
পাখী বলো, পবন বলে, সবাই ভয়ে কাঁপে।
যুগের পরে যুগ চলে যায় পাইনে সমাচার,
আছ্ড়ে কাঁদে পাষাণ হিয়া, হয় না সে চুর্মার।
ভাবনাতে তার হায় গিরি সব চুল যে তোমার সাদা,
উমার আগমনেও হৃদয় শূন্য যে রয় আধা।
প্রবোধ কারা দ্যায় আমারে আগমনীর গানে?
যে এল না তারি কথাই কাঁদায় আমার প্রাণে।

* * *

যুগের পরে যুগ চলে যায় কঙ্কালে কাল শিকল গাঁথে,
চোরাই সোনায় তৈরী পুরী ভোগ করে রাক্ষসের জাতে।
রক্ষকুলে উদয় হ’ল ইন্দ্রজয়ী দারুণ ছেলে
তাও দেখেছি চক্ষে; তবু সান্ত্বনা হয় কই সে মেলে,
দেখেছি মেঘনাদের শৌর্য্য,- হেঁট বাসবের উচ্চ মাথা!
হারিয়ে পূজা শক্র ধরেন শাক্যমুনির মাথায় ছাতা!
লেখা আছে এই পাষাণীর পাষাণ-হিয়ার পটে সবই,
হয়নি তবু দেখার অন্ত দেখব বুঝি আরেক ছবি-
ব’সে আছি শৈল-গেহে এক্লা আমার বিজন বাসে
জাগিয়ে এ মোর মাতৃহিয়া ইন্দ্রপাতের সুদূর আশে।
ব্যর্থ কভু হবে না এই অন্তি হিয়ার তীব্র শাপ-
তার তুষানল- মনস্তাপে, দ্যায় যে বৃথা মনস্তাপ।
মাতৃহিয়ায় দুঃখ দিলে জ্বলতে হবে জ্বলতে হবে,
স্বর্গে মৰ্ত্ত্যে রাজা হ’লেও আসন’পরে টলতে হবে।
অভিশাপের ভস্ম-পুতুল বিরাজ কর সিংহাসনে,
নিশ্বাসেরও সইবে না ভর, মিশ বে হঠাৎ স্বপ্ন সনে।