ইন্‌সাফ্‌

ডঙ্কা নিশান সঙ্গে লইয়া
লস্কর অফুরান্
রাজ্য পরিক্রমায় চলেন
সুল্তা‌ন বুল্‌বান্‌।
স্নিগ্ধ নয়নে প্রসাদ-সত্র
প্রতাপ-ছত্র-মাথে
চলেছেন রাজা দিল্লী নগরী
ছলে যেন তার সাথে;
সাথে সাথে চলে উর্দ্দ-বাজার,
হাজার হাজার হাতী,
চলেছে জোয়ান পাঠ্ঠা পাঠান
হাতে নিয়ে ঢাল কাতী।
বল্লম-ধারী চলে সারি সারি
ফলায় আলোক জ্বলে,
প্রজার নালিশ শুনিয়া ফেরেন
মালিক সদলবলে।
কত সাজা কত শিরোপা বিতরি’
নগরে নগরে, শেষে
হাওদা নড়িল, ছাউতি পড়িল
বদাউন্পুরে এসে।
দিল্লীপতির প্রিয়পাত্র সে
বদাউন্-সর্দ্দার,
নগরী সাজিল নাগরীর মতো
ইসারায় যেন তার।
কোথাও দুঃখ নাই যেন, কোনো
নাইক নালিশ কারু,
দুনিয়া কেবল ঢালা মখ্মল্
চুম্কির কাজে চারু।
আতর গোলাব আর কিঙ্খাব
যেন বদাউন্পুরে
রাজপুরুষের প্রসাদে প্রজার
হয়েছে আটপহুরে।
ভোজে আর নাচে কুচে ও কাওয়াজে
কাটে দিন মৃগয়ায়,
লোক খাসা অতি বদাউন-পতি
সন্দেহ নাই তায়।
বিশ্রামে বিশ্রস্তু আলাপে
কাটে দিন কোথা দিয়ে,
রাজ-অতিথির বিদায়ের দিন
ক্রমে আসে ঘনাইয়ে।
বদাউন-বনে সেবারের মতো
শীকার করিয়া সারা
দঙ্গল ফিরে সুল্তা‌ন সহ
উল্লাসে মাতোয়ারা।
সঙ্গে চলেন বদাউন্-পতি
করিয়া তূৰ্য্যনাদ,
সহসা কে নারী উঠিল ফুকারি’
“সুল্তা‌ন! ফরিয়াদ!”
চমকি চাহিয়া বদাউন্-পতি
বক্‌বক্‌ মিঞা কন্-
“দেওয়ানা! দেওয়ানা! হটাও উহারে,
কি দ্যাখো সিপাহীগণ।”
সুল্তা‌ন কন- “না, না, আনো কাছে,
কি আছে নালিশ, শুনি।”
প্রমাদ গণিয়া আড়ে চায় যত
ওম্‌রাহ বদাউনী।
শাহান্শাহের হুকুমে সিপাহী
কাছে গেল জেনানার,
আঁখি বিস্ফারি’ কাছে এল নারী
বাদশাহী হাওদার।
“কিবা ফরিয়াদ? কহ ফরিয়াদী,
নালিশ কাহার পরে?”
“ভয়ে কব? কিবা নিৰ্ভয়ে প্রভু!”
পুছে সে যুক্ত করে।
“নিৰ্ভয়ে কও!” বলেন হাকিম।
নারী কয় ঋজুকায়া,-
“হত্যাকারীরে সাজা দাও, প্রভু!
জগৎপ্রভুর ছায়া!
স্বামীরে আমার হত্যা করেছে
বদাউন-সর্দ্দার,
এই মাতালের কোড়ার প্রহারে
জীবন গিয়েছে তার।”
“কে তোর সাক্ষী, মিথ্যাবাদিনী,
কে তোর সাক্ষী, শুনি?”
“ধৰ্ম্মের প্রতিনিধি এসেছেন,
বুঝে কথা কও, খুনী!
সাক্ষী খুঁজিছ? সাক্ষী আমার
সারা বদাউন-ভূমি,
সাক্ষী আমার ওই কালামুখ,
আমার সাক্ষী তুমি।
সাক্ষী, তোমারি ভৃত্য, যাহারে
গিলেছ পাষাণ-কারা,
আমার সাক্ষী রাজপুরুষেরা
নালিশ নিলে না যারা।”
বজ্ৰদীপ্ত যুগল চক্ষে
সুল্তা‌ন বুল্‌বান্‌
চর-পরিষদ্-পতিরে করেন
সঙ্কেতে আহ্বান।
নিভৃতে তাহারে কি কহিল নৃপ,
নিমিষে ছুটিল চর,
নিমেঘে আসিল কয়েদখানার
সাক্ষীরা তৎপর।
আসিল কোরান, সাক্ষী-জবান্
বন্দী হইল পাকা,
সাক্ষ্য-প্রমাণ-বাক্য নারীর,
নয় মিছে নয় ফাঁকা।
বচন-দক্ষ মিথ্যা পক্ষ
হেরে গিয়ে হ’ল রূঢ়,
বর্ব্বরতায় গর্ব্বের বেশে
জাহির করিল মূঢ়!
ঘৃণায় বক্র ভুরু ভূপতির,
নয়নে আগুন জ্বলে,
হুকুমে লুটাল বক্বক্ খাঁর
উষ্ণীষ ধূলিতলে।
ঘোড়া ছেড়ে রাজপথে দাঁড়াইল
বদাউন-সর্দ্দার,
হাতে পায়ে বেঁধে শিকল, সিপাহী
কেড়ে নিল তলোয়ার।
কোড়া নিয়ে এল কোড়া-বর্দ্দার
বাদ্শাহী ইঙ্গিতে,
বজ্র-কঠোর স্বরে বাদ্শার
অপরাধী কাঁপে চিতে।
“দোষী সর্দ্দার, ভুল নাই আর,
দোষীর শাস্তি হবে,
রাজার প্রতিভূ রাজার সুনাম
ঢেকেছে আগৌরবে।
রাজপুরুষেরা প্রজারে বাঁচাবে
চোর-ডাকাতের হাতে,
কে বলে প্রজারে রক্ষিবে রাজ-
পুরুষের উৎপাতে?
রক্ষক যদি হয় ভক্ষক
কে দিবে তাহারে সাজা?
রাজপুরুষের রাহু-ক্ষুধা হ’তে
প্রজারে বাঁচাবে?- রাজা।
এই তো রাজার প্রধান কৰ্ম্ম,
এ বিধি সুপ্রাচীন,
এই ধৰ্ম্মের করিব পালন
মানিব না ধনী দীন।
গরীবের প্রাণ, আমীরের প্রাণ,-
সমান যে জন জানে,
সর্দ্দারী তারি- সুল্তানী তারি-
দুনিয়ার মাঝখানে;
গরীবের প্রাণ তুচ্ছ যে মানে
অরি তার ভগবান্,
কোড়ার প্রহারে প্রাণ যে নিল, সে
কোড়াতেই দিবে প্রাণ!
আর যারা তাজ মুলুকের তাজ
রাজার নিয়োগ পেয়ে,
ছোটোর নালিশ তোলে নাই কানে
বড়দের মুখ চেয়ে,
খুনের খবর গুম্ ক’রে যারা
রেখেছে রাজার কাছে,
খুনীর দোসর শয়তান তারা,-
দাও ঝুলাইয়া গাছে।
বে-ইমানী সনে রফা ক’রে চলা
জানে না মুসলমান,
কাজে আজ করে সে কথা প্রমাণ
দুনিয়ায় বুল্বাল।
বলবান্ ব’লে খুনীর খাতির?
হবে না; হবে না মাফ,
কসুর করিলে পুরা পাবে সাজা-
এই মোর ইন্‌সাফ।”