জাতির পাঁতি

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলল বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারি সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
কৃত্রিম ভেদ ধূলায় লোটে।
রাগে অনুরাগে নিদ্রিত জাগে
আসল মানুষ প্রকট হয়,
বর্ণে বর্ণে নাই রে বিশেষ
নিখিল জগৎ ব্ৰহ্মময়।
যুগে যুগে মরি কত নির্ম্মোক
আমরা সবাই এসেছি ছাড়ি’
জড়তার জাড়ে থেকেছি অসাড়ে
উঠেছি আবার অঙ্গ ঝাড়ি’;

উঠেছি চলেছি দলে দলে ফের
যেন মোরা হ’তে জানিনে আলা,
চলেছি গো দূর-দুর্গম পথে
রচিয়া মনের পান্থশালা;
কুল-দেবতার গৃহদেবতার
গ্রাম-দেবতার বাহিয়া সিড়ি
জগৎ-সবিতা বিশ্বপিতার
চরণে পরাণ যেতেছে ভিড়ি’।
জগৎ হয়েছে হস্তামলক
জীবন তাহারে ধরেছে মুঠে
অভেদের বেদ উঠেছে ধ্বনিয়া,-
মানস-আভাস জাগিয়া উঠে!
সেই আভাসের পুণ্য আলোকে
আমরা সবাই নয়ন মাজি,
সেই অমৃতের ধারা পান করি’
অমেয় শকতি মোদের আজি।
আজি নির্ম্মোক-মোচনের দিন
নিঃশেষে গ্লানি ত্যজিতে চাহি,
আছাড়ি আকুলি আস্ফালি তাই
সারা দেহ মনে স্বস্তি নাহি।
পরিবর্তন চলে তিলে তিলে
চলে পলে পলে এমনি ক’রে,
মহাভুজঙ্গ খোলোস খুলিছে
হাজার হাজার বছর ধরে!
গোত্র-দেবতা গর্ত্তে পুতিয়া
এশিয়া মিলাল শাক্যমুনি,
জাতির পাতি আর দুই মহাদেশের মানুষে
কোন্ মহাজন মিলাল শুনি!
আসিছে সেদিন আসিছে সেদিন
চারি মহাদেশ মিলিবে যবে,
যেই দিন মহা-মানব-ধৰ্ম্মে
মনুর ধৰ্ম্ম বিলীন হবে।
ভোর হয়ে এল আর দেরী নাই
ভাঁটা শুরু হ’ল তিমির স্তরে,
জগতের যত তুৰ্য-কণ্ঠ।
মিলিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে!
মহান্ যুদ্ধ মহান্ শান্তি
করিছে সূচনা হৃদয়ে গণি,
রক্ত-পঙ্কে পঙ্কজ-বীজ
স্থাপিছেন চুপে পদ্মযোনি।
ভোর হ’য়ে এল ওলো! আঁখি মেল
পূরবে ভাতিছে মুকুভাতি,
প্রাণের আভাসে তিতিল আকাশ
পাণ্ডুর হ’ল কৃষ্ণা রাতি।
তরুণ যুগের অরুণ প্রভাতে
মহামানবের গাইয়ে জয়-
বর্ণে বর্ণে নাহিক বিশেষ
নিখিল ভুবন ব্ৰহ্মময়।
বংশে বংশে নাহিক-তফাৎ
বনেদী কে আর গর্-বনেদী
দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ
দুনিয়া সবারি জনম-বেদী।

রাজপুত আর রাজা নয় আজ
আজ তারা শুধু রাজার ভূত,
উগ্রতা নাই উগ্ৰক্ষেত্রে
বনেদ হয়েছে অমজবুত।
নাপিতের মেয়ে মুরার দুলাল
চন্দ্রগুপ্ত রাষ্ট্রপতি,
গোয়ালার ভাতে পুষ্ট যে কানু
সকল রথীর সেরা সে রথী।
বঙ্গে ঘরানা কৈবৰ্ত্তেরা,
বামুন নহে গো- কায়েৎও নহে,
আজো দেশ কৈবর্ত রাজার
যশের স্তম্ভ বক্ষে বহে।
এরা হেয় নয়, এরা ছোট নয়;
হেয় তো কেবল তাদেরি বলি-
গলায় পৈতা মিথ্যা সাক্ষ্যে।
পটু যারা করে গঙ্গাজলী;
তার চেয়ে ভালো গুহক চাঁড়াল,
তার চেয়ে ভাল বলাই হাঁড়ী,-
যে হাড়ীর মন পূজার আসন।
তারে মোরা পূজি বামুন ছাড়ি,
ধৰ্ম্মের ধারা ধরেছে সে প্রাণে
হাড়ীর হাড়ে ও হাড়ীর হালে
পৈতা তো সিকি পয়সার সূতা
পারিজাত-মালা তাহার ভালে।
বইদাস মুচি, সুদীন কসাই,-
গণি শুকদেব-সনক-সাথে,
মুচি ও কসাই আর ছোটো নাই
হেন ছেলে আহা হয় সে জাতে।
চণ্ডাল সে তো বিপ্র-ভাগিনা
ধীবর-ভাগিনা যেমন ব্যাস,
শাস্ত্রে রয়েছে স্পষ্ট লিখন
নহে গো এ নহে উপন্যাস।
নবমাবতার বুদ্ধ-শিষ্য
ডোম আর যুগী হেলার নহে,
মগধের রাজা ডোম্নি রায়ের
কাহিনী জগতে জাগিয়া রহে।
মদের তৃষ্ণা শুড়িরে গড়েছে
মিছে তারে হায় গণিছ হেয়,
তান্ত্রিক দেশে মদের পূজারী
তাহ’লে সবাই অপাংক্তেয়।
কেউ হেয় নাই, সমান সবাই,
আদি জননীর পুত্র সবে,
মিছে কোলাহল বাড়ায়ে কি ফল
জাতির তর্ক কেন গো তবে?
বাউরী, চামার, কাওরা, তেওর,
পাট্নী, কোটাল, কপালী, মালো,
বামুন, কায়েৎ, কামার, কুমোর,
তাঁতি, তিলি, মালি সমান ভালো;
বেনে, চাষী, জেলে, ময়রার ছেলে,
তামূলী, বারুই তুচ্ছ নয়;
মানুষে মানুষে নাহিক তফাৎ,
সকল জগৎ ব্রহ্মময়!

সেবার ব্রতে যে সবাই লেগেছে
লাগিছে- লাগিবে দু’দিন পরে,
মহা-মানবের পূজার লাগিয়া
সবাই অর্ঘ্য চয়ন করে।
মালাকর তার মাল্য জোগায়
গন্ধবেনের গন্ধ আনে,
চাষী উপবাসী থাকিতে না দেয়,
নট তারে তোষে নৃত্যে গানে,
স্বর্ণকারের ভূষিছে সোনায়,
গোয়ালা খাওয়ায় মাখন ননী,
তাঁতিরা সাজায় চন্দ্রকোণায়,
বণিকেরা তারে করিছে ধনী,
যোদ্ধারা তারে সাঁজোয়া পরায়,
বিদ্বান্ তার ফোটায় আঁখি
জ্ঞান-অঞ্জন নিত্য জোগায়
কিছু যেন জানা না রয় বাকী।
ভাবের পন্থা ধরে সে চলেছে
চলেছে ভবিষ্যতের ভবে,
জাতির পাতির মালা সে গাঁথিয়া
পরেছে গলায় সগৌরবে।
সরে দাড়া তোরা বচন-বাগীশ
ভেদের মন্ত্র ডুবা রে জলে,
সহজ সবল সরস ঐক্যে
মিলুক মানুষ অবনীতলে।
ডঙ্কা পড়েছে শঙ্কা টুটেছে
দামামা কাড়ায় পড়েছে সাড়া,
জাতির পাতি মনে কুণ্ঠার কুষ্ঠ যাদের
তারা সব আজ সরিয়া দাঁড়া।
তুষার গলিয়া ঝোরা দুরন্ত
চলে তুরন্ত অকূল পানে
কল্লোল ওঠে উল্লাসভরা
দিকে দিগন্তে পাগল গানে;
গণ্ডী ভাঙিয়া বন্ধুরা আসে
মাতেরে হৃদয় পরাণ মাতে,
গো-ত্র আঁকড়ি গরুরা থাকুক
মানুষ মিলুক মানুষ সাথে।
জাতির পাঁতির দিন চ’লে যায়
সাথী জানি আজ নিখিল জনে,
সাথী বলে জানি বুকে কোলে টানি
বাহু বাঁধে বাহু মন সে মনে।
যুদ্ধের বেশে পরমা শান্তি
এসেছে শঙ্খ চক্র হাতে,
প্লাবন এসেছে পাবন এসেছে
এসেছে সহসা গহন রাতে।
পঙ্কিল যত পলে আজ
শোনো কল্লোল বন্যাজলে!
জমা হ’য়ে ছিল যত জঞ্জাল।
গেল ভেসে গেল স্রোতের বলে
নিবিড় ঐক্যে যায় মিলে যায়
সকল ভাগ্য সব হৃদয়,
মানুষে মানুষে নাই যে বিশেষ
নিখিল ধরা যে ব্ৰহ্মময়।।