জিন্

নিরজন
নিদপুর,-
নিকেতন
মৃত্যুর;
বায়ু, হায়,
মুরছায়,
ঢেউ নাই
সিন্ধুর।
আকাশ জুড়ে
একি আভাষ।
নিশার পড়ে
ঘন নিশাস!
কাহারা ধায়
প্রেতের প্রায়
অনল ভায়
মানি’ তরাস।

ঘোর কলরব।
তন্দ্রা মিলায়;
হ্রস্ব দানব
অশ্ব চালায়।
পলায় যে রড়ে
তারি ‘পরে পড়ে,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে চড়ে
নৃত্য-লীলায়!

কাছে আসে হুঙ্কার,
ধ্বনিছে প্রতিধ্বনি;
পুণ্যের কারাগার
মঠে কি মন্যু-ফণী?
কিবা ঘন-জনতায়
বজ্ৰ ঘোষণা ধায়,
কভু মৃদু,- মরি’ যায়,
কভু উঠে রণরণি।

কি সর্বনাশ! ফুকারিছে জিন!
তাই হলহলা উঠেছে, ওরে!
পালা যদি চাস বাঁচিতে দু’দিন।
এই বেলা ওই সোপান ধরে’।
গেল,- নিবে গেল প্রদীপ আবার,
কালিমায় ঢেকে গেল চারিধার,
গ্রাসি’ ঘর দ্বার নিকষ আঁধার
বসিল চড়িয়া হর্ম্ম্য ‘পরে।

সাজ ক’রে আজ বেরিয়েছে জিন্ যত,
ঘূর্ণিবাতাসে পড়ে গেছে ‘হুস’ ‘হাস’!
দাব-দহনেতে দীর্ণ তরুর মত
পর্ণ ঝরায়ে ঝাউ ফেলে নিশ্বাস!
ধায় জিন্ যত শূন্যে পাইয়া ছাড়া,
অদ্ভুত-গতি দ্রুত অতি চলে তারা;
সীসার বরণ ভীষণ মেঘের পারা
বজ্র যখন কুক্ষিতে করে বাস।
এল কাছে আরো,- এল ঘিরে এল ক্রমে এ যে!
আগুলি দুয়ার দাঁড়াও, যুঝিব প্রাণপণে;
কি গণ্ডগোল বাহিরে আজিকে ওঠে বেজে!
দৈত্য দানার হানা-দেওয়া ঘোর গর্জ্জনে।
বেঁকে নুয়ে পড়ে বাহাদুরী কড়িকাঠ যত,
জলজ কোমল নমনীয় লতিকার মত!
নাড়া পেয়ে কাঁপে পুরাণো জানালা দ্বার কত
মরিচায় জরা কবচের ক্ষীণ বন্ধনে।

বিমরি’ গুমরি’ গরজিছে এ যে নরকের কলরব!
উত্তর-বায়ু চলেছে তাড়ায়ে পিশাচ প্রেতের পাল!
এবার রক্ষা কর ভগবান! কালো পণ্টন সব
পদ-ভরে ভেঙে ফেলে বুঝি ছাদ! একি হ’ল জঞ্জাল!
প্রাচীর হেলিছে, দুলিছে, টলিছে, সারা গৃহ যেন কাঁদে;
সূৰ্য্য বুঝি গো কক্ষ ছাড়িয়া প্রলয়-ঝঞ্চা-ফাঁদে
পড়ে গিয়ে আজ কেবলি গড়ায় শুষ্ক পাতার ছাঁদে;
ঘুর্ণি হাওয়ায় টেনে নিয়ে যায়, দাঁড়ায় না ক্ষণকাল।

হজরৎ! আজ বান্দা ঠেকেছে বড় দায়,
নিশাচর পাপ পিশাচের হাতে কর ত্রাণ;
মুণ্ডিত শিরে বার বার নমি তব পায়,
ভয়বিহ্বলে নির্ভয় কর, রাখ প্রাণ।
এই কর প্রভু! কুহকী প্রেতের যত ছল,
ভকতের দ্বারে এসে হয় যেন হতবল;
পক্ষ-লগন নখে আঁচড়িয়া সাসিতল,
আক্রোশে তারা ফিরুক শিকার করি’ ঘ্রাণ।

গেছে, চলে গেছে!- চলে গেছে জিন্ যত;
উড়িয়া পড়িয়া ছুটেছে গগন-পারে!
ছাদে থেমে গেছে নৃত্য সে উদ্ধত,
শত করাঘাত আর পড়িছে না দ্বারে।
শিহরে কানন পলায়ন-বেগ-ভরে,
শিকল বেড়ীর শব্দে আকাশ ভরে,
গ্রামের প্রান্তে সীমাহীন প্রান্তরে
শালতরু যত নুয়ে পড়ে সারে সারে।

ধীরে, ধীরে, ধীরে, দূরে, দূরে, দূরে,
পাখার আওয়াজ মিলায়ে আসে।
মৃদু হ’তে ক্রমে মৃদুতর সুরে
কঁপে সে আসিয়া কানের পাশে!
মনে হয়, শুনি ঝিল্লির ধ্বনি,
স্পন্দিছে সারা নিথর ধরণী,
কিবা শিলাপাতে মৃদু ঠন ঠনি
পুরাণো ছাদের শেহালা-রাশে।

সেই অপরূপ ধ্বনি।
শোনা যায়! শোনা যায়!
শিঙার শব্দ গণি’
বেদুইন্ ফিরে চায়!
তটিনী-তটের তান,
উচ্ছাসে অবসান!
সোনালি স্বপ্ন-খান্
শিশুর নয়ন ছায়।

জিন্ বিভীষণ,-
মৃত্যুর চর,
আঁধারে গোপন,
করে কলেবর;
করে গরজন
গভীর, ভীষণ,
ঢেউয়ের মতন;
রহি’ অগোচর।

ঘুমায়ে পড়ে
মৃদুল স্বর,
ঢেউ কি নড়ে
তটের ‘পর!
প্রেতের লাগি’
মুক্তি মাগি’
জপে কি যোগী
যুক্তকর!
মনে হয়,
কুস্বপন,
কানে কয়
অনুখন!
কে কোথায়!
মিশে যায়!
মূরছায়
গরজন!

ভিক্তর হুগো।