কয়াধু

[দিতি ও কশ্যপের পুত্র অসুর সম্রাট্ হিরণ্য-কশিপুর পত্নী কয়াধু!
ইনি জস্তাসুরের কন্যা ও মহিষাসুরের ভগিনী। ইহার চারি পুত্র- প্রহ্লাদ, সংহলাদ, হলাদ ও অমুহলাদ।]

কার তরে এই শয্যা দাসী, রচিস্ আনন্দে?
হাতীর দাঁতের পালঙ্কে মোর দে রে আগুন দে।
পুত্র যাহার বন্দীশালায় শিলায় শুয়ে, হায়,
ঘুম যাবে সে দুধের-ফেন ফুলের-বিছানায়?
কুমার যাহার উচিত কয়ে সয় অকথ্য ক্লেশ,
সে কি রাজার মন ভোলাতে পর্বে ফুলের বেশ?
দুলাল যাহার শিকল-বেড়ীর নিগ্রহে জর্জ্জর,
জন্তলিকা! রত্ন-মুকুট তার শিরে দুর্ভর।
পার্ব না আর করতে শিঙার রাখতে রাজার মন,
জঞ্জালে ডাল্ জঞ্জাল-জাল রাণীর আভরণ!

ফণীর মতন রাজার দেওয়া দংশে মণিহার,
যম-যাতনা এখন এ মোর রম্য অলঙ্কার!
কেয়ূর-কাঁকণ শিথ্লে দে রে, খুলে দে কুণ্ডল,
শিখ্লে দে এই মোতির সীঁথি শচীর আঁখিজল!
রাণীত্বে আর নাই রে রুচি- নাই কিছুরই সাধ,
যে দিকে চাই কেবল দেখি লাঞ্ছিত প্রহলাদ!
যে দিকে চাই মলিন অধর, উপবাসীর চোখ
যে দিকে চাই গগন-ছোঁয়া নীরব অভিযোগ,
যে দিকে চাই ব্রতীর মূর্ত্তি নিগ্রহে অটল,
সাপের সাথে শিশুর খেলা,- মন করে বিহ্বল।
মারণ-পটু মার্ছে বটু- মার্ছে বাছারে,
শস্ত্রপাণি দিচ্ছে হানা বালক নাচারে,
কাঁটায় গড় মার্ছে কোড়া তুধের ছেলের গায়,
দ্যাখ্ রে রাঙ্গা দাগ্ড়াতে দ্যাখ্ আমার দেহ ছায়!
প্রাণের ক্ষতে লোহুর ধারা ঝরছে লক্ষ ধার,
আর চোখে নিদ্ আস্বে ভাবিস্ পালঙ্কে রাজার?
গুমে গুমে পুড়ে যেন যাচ্ছে শরীর মন,
ক্লান্ত আঁখি মুদ্লে দেখি কেবল কুস্বপন,
পাহাড় থেকে আছ্ড়ে ফেলে দিচ্ছে পাথরে-
প্রহলাদে মোর; দিচ্ছে ঠেলে সাপের চাতরে।
জগদ্দলন পাষাণ বুকে ফেল্ছে তরঙ্গে,
চোরের সাজে সাজিয়ে সাজা চোরেরি সঙ্গে!
নির্দ্দোষের খুনীর বাড়া দিচ্ছে রে দণ্ড।
কালনেমি, কবন্ধ, রাহু দৈত্য পাষণ্ড।
কভু দেখি ফেল্ছে বাছায় পাগ্লা হাতীর পায়-
বিদ্রোহীদের প্রাপ্য সে আজ নিরীহ জন পায়!
চর্ম্মচোখে রক্ত ঝরে দারুণ সে দৃশ্যে,
মর্ম্মচোখে কেবল দেখি……নৃসিংহ বিশ্বে!

★ ★ ★

হায় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ!….হাহা রে আফ্শোষ,
অপ্রযুক্ত দণ্ড এ যে,… জাগায় বিধির রোষ!
কি দোষ বাছার বুঝ্তে নারি, অবাক্ চোখে চাই,
ইচ্ছা করে এ দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাই-
অন্য কোথাও- অন্য কোথাও- এ রাজ্যে আর নয়,
ভাগ্যে আমার স্বর্গপুরী হ’ল ভীষণ-ভয়,
চোখের আগে কেবল জাগে ছেলের মলিন মুখ,
খড়্গে জেতা স্বর্গপুরে নাই রে স্বর্গ-সুখ।
বুঝ্তে নারি কী দোষ বাছার,… ভাবি অহর্নিশ,
ষণ্ড গুরুর শিক্ষা পেয়েও ষণ্ডামি তার বিষ,…
এই কি কসুর অপাপ শিশুর? হায় রে কে জানে,
বিহ্বলতায় বিকল করে এ মোর পরাণে।…
ফিরে এল শিক্ষা-শেষে শিশু পুলক-মন,
ভীষণ সাপের আবর্ত্তে হায় এই সমাবর্ত্তন!
প্রশ্ন হ’ল- “কি শিখেছে?” রাজার সভা-মাঝে
কয় শিশু- -“তাঁর নাম শিখেছি রাজার রাজা যে;
যাঁর আদি নাই, অন্তও নাই, যে-জন চিরন্তন,
সত্য-মূর্ত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্তি অরূপ নিরঞ্জন,
তিন ভুবনের প্রভু যিনি, প্রভু যে চার যুগে,
শিখেছি নাম জপ্তে তাঁহার, গাইতে সে নাম মুখে।”
ছেলেব বোলে রুষ্ট রাজা দেবত্ব-লোভী,
ছেলের দেব-প্রেমে দ্যাখেন বিদ্রোহ-ছবি।

বিধির বরে দেব্তা-মানুষ-পশুর অবধ্য
মাতেন পিয়ে অহঙ্কারের অপাচ্য মদ্য।
ভাবেন মনে “হইছি আমর” অবধ্য বলেই!
পরের বধ্য নয় ব’লে, হায়, মৃত্যু ষেন নেই!
দেবতা-মানুষ-পশুর বাইরে কেউ যেন নেই আর
বলের দর্পে দণ্ড দিতে; এম্নি ব্যবহার!
দাবী করেন দেবের প্রাপ্য যজ্ঞ-হবির ভাগ,
ভগবানের জয়-গানে হায় বাড়ে উহার রাগ!
উনিই ষেন রুদ্র, মরুৎ, উনিই সূর্য্য, সোম,
ক্ষণস্থায়ী রাজ্যমদে দণ্ডধারী যম।
ইন্দ্র উনি ইন্দ্রজয়ী, জয়ন্ত, জিষ্ণু,
এক্লা উনি সব দেবতা, নাসত্য, বিষ্ণু।
ছেলের বোলে ক্রোধোন্মত্ত দৈত্য ধুরন্ধর,
“আমার আগে অন্যে বলে ত্রিভুবনেশ্বর!
রাজদ্বেষী আমন ছেলে, ফল বা কি জীয়ে?
ডুবিয়ে দেব নির্য্যাতনের নরক সৃজিয়ে।
খর্ব্ব করে রাজায় যে তার রাখ্ব না মাথা,
দণ্ডবিধান কর্ব, স্বয়ং আমিই বিধাতা!”
বাক্য শুনে বালক বলে বিনয় বচনে-
“হৃদয় আমার নিরত যাঁর অর্ঘ্য-রচনে,
পিতার পিতা মাতার মাতা রাজার রাজা সেই,
সত্য তিনি নিত্য তিনি তাঁর তুলনা নেই;
পিতা গুরু,… মান্য করি,… শ্রদ্ধা দিই ভূপে,…
তাই ব’লে হায় ভুল্তে নারি সত্য-স্বরূপে।
আত্মা…. আপন বিশিষ্টতা… কব্ব না ক্ষুন্ন,…
স্মরণে যাঁর মরণ মরে,… কীর্ত্তনে পুণ্য,…
সে নাম আমি ছাড়্ব নাকো, ছাড়্ব না নিশ্চয়;
অঙ্গে যিনি, অস্ত্রে তিনি,- শাস্তিতে কি ভয়?”
কথার শেষে কোটাল এসে বাঁধলে ক’সে তায়,
শান্ত শিশু হাস্ল শুধু শিষ্ট উপেক্ষায়।
চ’লে গেল শাস্তি নিতে নিরীহ প্রহ্লাদ-
আত্মলাভের মূল্য দিতে প্রহারে সাহ্লাদ!
মিনতি-বাল্ বল্তে গেলাম দৈত্যপতিরে
বিমুখ হ’য়ে, আঁকড়ে বুকে নিলাম ক্ষতিরে,
ছেড়ে এলাম সভাগৃহ বাক্য-যন্ত্রণায়
সিংহাসনের আসনে ভাগ ঠেলে এলাম পায়,
ভাব-দেহে যাই লাগল আঘাত, হায় রে কয়াধু,
স্থূল-শরীরও মরিয়া হ’ল, টিক্ল না যাদু।
চ’লে এলাম রাজ্য রাজা ডুবিয়ে উপেক্ষায়,-
সত্য যেথা পায় না আদর চিত্ত বিমুখ তায়।
আসার পথে দেখে এলাম কেবল অলক্ষণ,-
বিম্বিল মোর বিধবা-বেশ স্তম্ভ অগণন!
ব্যাকুল চোখে চাইতে ফাঁকে চোখ হ’ল বন্ধ,
মশানে স্ব-মুণ্ডে লাথি ঝাড়্ছে কবন্ধ!
ক্ষিপ্ত-পারা আকাশে চাই, সেথায় দেখি হয়,
রক্ত-স্নাত সিংহ-শীর্ষ পুরুষ অতিকায়,
অঙ্গে তাহার লুটায় কে রে মুকুট-পরা শির,
সিংহনখে ছিন্ন অন্ত্র চৌদিকে রুধির!
দু’হাতে চোখ ঢেকে এলাম অন্ধ আশঙ্কায়
ভিত্তি-‘পরে কপাল ঠুকে কেবল প্রতি পায়।
সেই অবধি শুন্ছি কেবল অন্তরে গুর্গুর্
বিসর্জ্জনের বাজ্না বাজায় বিপর্য্যয়ের সুর,
টল্ছে মাটি নাগ বাসুকী অধর্ম্মেরি ভার
হাজার ফণা নেড়ে করে বইতে অস্বীকার।
যে বিধি নয় ধর্ম্ম্য, বুঝি, তার তাজি রোখ-শোধ;
বিধির টনক নড়ায় শিশুর শিষ্ট প্রতিরোধ।
বিধি-বহিস্কৃতের বিধি মান্বে না কেউ আর,
ওই শোনা যায় জম্ভলিকা! নৃসিংহ-হুঙ্কার!
রেখে দে তোর শয্যা-রচন রাণীর পালঙ্কে,
হৃষীকেশের শাঁখ হৃদে শোন্ হর্ষে- আতঙ্কে!
ভীষণ মধুর রোল উঠেছে রুদ্র আনন্দে,
সুখের বাসায় সুখের আশায় দে রে আগুন দে।
দুঃখ বরণ করেছে মোর নির্দ্দোষী প্রহলাদ,
সেই দুখে আজ আঁক্ড়ে বুকে চল্ করি জয়নাদ।
আত্মা চাহে শিশুর রূপে প্রাপ্য যাহা তার,-
বিদ্রোহ নয় বিপ্লবও নয় ন্যায্য অধিকার।
উচিত ব’লে দণ্ড নেবার দিন এসেছে আজ,
উচিত ক’রে পর্তে হবে চোর-ডাকাতের সাজ,
চিত্ত-বলের লড়াই কুরু পশু-বলের সাথ,
বন্যা-বেগের হানার মুখে কিশোর-তনুর বাঁধ!
প্রলয়-জলে বটের পাতা! চিত্ত-চমৎকার!
তীর্থ হ’ল বন্দীশালা, শিকল অলঙ্কার।
খেদ কিছু নাই, আর না ডরাই, চিত্তে মাভৈঃ রব,
উচিত ব’লে বন্দী ছেলে এ মম গৌরব!
কয়াধু তোর জনম সাধু, মোছ রে চোখের জল,
রাজ-রোষেরি রোশনায়ে তোর মুখ হ’ল উজ্জ্বল!