কুঙ্কুম পঞ্চাশৎ

(১)
এল উতল হাওয়া ফুল-পুলক নিয়ে!
ক্ষীর সায়র জলে আলো-ঝলক দিয়ে!
এল মধুর হেসে
মরি বঁধুর বেশে
এল ঘুমের দেশে রাঙা আরক পিয়ে!

(২)
ওই নিশান তুলে এল নতুন! তাজা!
এল ফাগুন রাজা ওরে বাজন বাজা!
এল মোহন রূপে
এল কখন্ চুপে
এই নবীন ভূপে তোরা রাখাল সাজা।

(৩)
ওলো হাওয়ায় ঝরে আজ ফাগের ঝোরা
এল ভুবন ‘পরে ওই হোরীর হোরা!
তার হাসির গুড়া
রাঙা কৃষ্ণচূড়া,
সখী অশোক বনে তার রাখীর ডোর!

(৪)
রঙে রঙীন্ হ’ল কে ও প্রাণের পুরে!
তারি রভস লাগে যে গো গানের সুরে!
তারি আবেশ ঝরে
রাঙা রঙন্ ‘পরে
ঝরে মেঘের থরে ঝরে ভুবন জুড়ে!

(৫)
এল হোরীর হোর ওই হুরীর সেরা!-
নয়ন সোজা সই নজর টেরা!
সারা ভুবন জুড়ি
ও যে ফোটায় কুঁড়ি
গাছের গুড়ি করে রসের ডেরা!

(৬)
আজ কোকিল কূজে পিচ্কারীর সুরে!
পিচ- কারীই ফুরে আজ তৃণাঙ্কুরে!
পিচ- কারীর রীতি
চলে ফাগুন-গীতি
পিচ- কারীর লীলা প্রাণে- গোপন পুরে!

(৭)
এল মলিন চোখে ফিরে উজল চাওয়া!
এল ভুবন-জাড়া যৌবনের হাওয়া!
এল পাখীর ডাকে
এল শাখীর শাখে
কাঁচা রোদের ফাঁকে তাজা পাতার ছাওয়া!

(৮)
-কোথা চামেলি ফুলে নিতি ঝামেলা বল্?
-অনু- রাগের হাওয়া সই! যেথা প্রবল!
-কোথা ফাগুন নিতি?
-যেথা তরুণ প্রীতি!
-কোথা আবীর ওড়ে?- যেথা আদর কেবল।

(৯)
ওলো প্রথম হোলি সেই প্রথম চুমে!
ভ্রমর হ’ল লাল যে কুঙ্কুমে!
যবে পাগল পারা
পিচ্- কারীর ধারা
বুকের সুখে মেশে চোখের ঘুমে।

(১০)
আজি দখিন হাওয়া কোল দিয়েছে রে
প্রাণে যুব লেহা দোল দিয়েছে রে!
আজ ফুলের লোহে
দোঁহে রাঙাও দোঁহে
আজ লাজের আধা গোল গিয়েছে রে

(১১)
ওলো কাহার ভুলে বল্ কেমন ভুলে
গেল চাপার ফুলে লাল শিরীষ বুলে!
কারে মরম বলি
এ যে লাজের হোলি
হেরি সকল প্রাণে আর প্রাণের কূলে!

(১২)
যদি মরম কহি তবে সরম টুটে
আজি বঁধুর মধু মোর প্রাণের পুটে!
তাই হিয়ার নীড়ে
মোর আবীর ফিরে
এই চরণ ঘিরে তাই কুসুম ফুটে!

(১৩)
-আজি মনে যে মনোজের কেল্লা হ’ল!
-জুঁই ফুলেতে জোছনার জেল্লা হ’ল!
রাকা চাঁদের আলো
পেয়ে ভ্রমর কালো
বেল্- ফুলের মালঞ্চে বেলেল্লা হ’ল!

(১৪)
আজ ফাগুন বায়ে আর ফাগুন চাঁদে
কেন এমন করে হায় আমায় সাধে!
পিক পাগল গানে
পিচ- কারীয়া তানে
হায় কী বোল্ বলে আজ কী আহলাদে!

(১৫)
এল হঠাৎ হোলি আজ কোথায় থেকে!
এল অশোক কলি পিচকারীর বেগে!
কালো কোকিল পাখী
হ’ল অরুণ আঁখি
কিশ- লয়ের রাঙা গেল হিয়ায় লেগে!

(১৬)
মরি কী দোল্ দিল আজি দখিন বায়ে!
প্রাণে পুলক লাগে-লাগে সকল গায়ে!
একি ভুবন-ভোলা
রসা- বেশের দোলা!
একি প্রেমের খেলা মরি মরণ-ছায়ে!

(১৭)
এল ফাগুন ফিরে এল ফাগুয়া নিয়ে!
ওরে আকুল হিয়া নিল আগু বাড়িয়ে!
এল মৃদুল ছুঁয়ে
ফুল ফুটিয়ে ফুঁয়ে
দূরে সরম থুয়ে রাঙা ফাগ হানিয়ে!

(১৮)
-আজ ফাগুন ব’লে ভুল সবার ঘটে।
-তাই সবুজ কিশলয় অরুণ বটে!
ভুল ভিতর থেকে
এল আবীর মেখে
হ’ল প্রথম হোলি তার স্বপন-তটে!

(১৯)
নব বকুল ফুলে গেঁথে নবীন মালা
দোলে দোলাস্ তালে ওলো গোপের বালা
গেল জাড়ের পালা
ওলো আগুন জ্বালা
গেল জড়ের রীতি হ’ল ভুবন আলা!

(২০)
রাঙা আগুন জ্বালা রং না হয় ফিকা!
হবে পলাশ-কলি ওই আগুন-শিখা!
ওই ছাই-এর রাশি
হবে ফুলের হাসি
যদি সকল নিবি তুই সকল বিকা’।

(২১)
হ’ল মশাল জ্বালা হ’ল মশাল জ্বালা!
দোলে আকাশ-ভালে কিংশুকের মালা!
গেল জাড়ের ভীতি
গেল জড়ের রীতি
নট- কোনার নটী হ’ল আবীর ঢালা!

(২২)
যারা পোড়ায় মেড়া সবে সুধাও হেঁকে,-
পোড়া আবার বেঁচে এল কোথায় থেকে?
দেখে আবীর ও যে
তাজা আগুন-বোঝে
শিং বাঁকায় খালি হায় বেসুর ডেকে!

(২৩)
জ্বাল আগুন জ্বাল ফিরে আগুন জ্বাল!
রাঙা পলাশ-ফুলে হ’ল রঙীন্ আলো!
গাও তরুণ-গীতি
দাও অরুণ প্রীতি
ওগো ঘুচাও আজি যত জাড়ের কালো

(২৪)
ও যা’ বাতিল হ’ল তারে কর ছাই রে;
আগুন জ্বেলে দেখ রোশ্নাই রে!
খোলো নতুন পাঁজি
চির- প্রাণের আজি
তাজা পাতায় হ’ল হাল্-খাতা ভাই রে!

(২৫)
ভালো- বাসার আলো জ্বলে যে অন্তরে
সাজে গরব তারে, সে-ই পরব করে।
যার মাণিক ভালে
তার সকল কালে
প্রাণে অকাল-কৌমুদী-উৎসব রে!

(২৬)
এল বিভোল্ হাওয়া মোর প্রাণের পরে
ও যে আঁচল টানে ও যে পাগল করে!
দিল আকুল ক’রে
সব আনুল করে
এল সরম-হারা নিল মরম হ’রে।

(২৭)
ওগো কিশোর হাওয়া তুমি কেমনতর?
যত বসন বাঁধি, তুমি শিথিল কর!
নাগা নিলাজ গাছে
তুমি সাজাও সাজে
যত প্রবীণ-রীতি তুমি বাতিল কর!

(২৮)
যার হরিণ-আঁখি সে কি কাজল পরে?
দোলে দোলায় যারে প্রেম সোহাগ ভরে!
যার আদর থাকে
সে কি আবীর মাখে
সাঁচা সরম-রঙে রাঙা কপোল ‘পরে?

(২৯)
সখী! কাজল পরা ভালো তারেই সাজে
যার হরিণ-আঁখি প্রেমে উজল রাজে।
যার অন্তরে রং-
ফাগ্ মানায় বরং-
যার আবীর ঘূরে সারা প্রাণের মাঝে!

(৩০)
ও যে সকল হিয়া বেঁধে কুসুম শরে
সবাই মার সই কাঁকন করে।
ওর আবীর লোহ
ওর রঙীন মোহ
পড়ুক ঝরে ঝরে ভুবন ‘পরে।

(৩১)
ওগো যে বাণ গড় নীল কমল দিয়ে
নয়ন-কোণে রাখ তায় লুকিয়ে!
আর আমের কুঁড়ি
রয় যে বাণ জুড়ি’
সে যে পুলক-ফুলে তনু দ্যায় ভরিয়ে!

(৩২)
তুমি যে বাণ গড় রাঙা অশোক ফুলে
রাঙা ঠোঁটেই সে রয়?- কিবা কপোল-মূলে?
অরবিন্দ আছে
কোন্ হিয়ার মাঝে?
হাসির তূণে মল্লিকায় থুলে?

(৩৩)

যার ধনুক ছিল গড়া- কুসুম দিয়ে-
রঙের গুঁড়া তারি ভস্ম কি এ!
এই আবীর মোহ
তারি বুকের লোহ?
তার চুমার রাঙা গেছে এই সাঁপিয়ে!

(৩৪)
প্রেমের হাওয়া বয় সেথাই হোরি!
যেথা হিয়ার রাঙা রং রাঙায়, গোরী!
যেথা কুসুম ফুটে
ওঠে প্রাণের পুটে
যেথা ফাগুন জুটে দিন ক্ষণ বিসরি

(৩৫)
ভালো-বাসার মানে এই- ফাগেই নাওয়া
ভালো বাসার প্রাণে চির-রঙীন্ হাওয়া
সে যে গুলাব-গোলা
রঙে লহর তোলা
আঁখি- জলের বানে সে যে মাণিক পাওয়া

(৩৬)
ও কে কিশোর ঠোঁটে শিশ্ ভারি দিয়েছে
শ্যামা পাখীর শিশে টিটকারী দিয়েছে!
ও যে মুকুল মনে
যৌবনের ক্ষণে
রঙের রসে পিচ্কারী দিয়েছে!

(৩৭)
ওতো ঝরেই যাবে ও যে ফাগের গুঁড়া
তবে আবীর উড়া’ রাঙা আবীর উড়া’
তবে চলুক হাসি
তবে বলুক বাঁশী
গলুক হিয়া সুখে সোহাগ কুড়া’।

(৩৮)
প্রাণে আবীর আছে যার হোলি খেল
অনু- রাগের রাঙা জাল মেল মেল!
চির স্বপন গাঁথা
যার আঁখির পাতা
ওগো সরম-বাধা সেই পায়ে ঠেল।

(৩৯)
-সখী আবীর গোলে বল্ কি জল দিয়ে?
-আঁখি- গুলাব কুঁড়ি সই! নিঙাড়িয়ে!
অনুরাগের আবীর
আর জল দু’আঁখির
সাঁচা হোলির খেলা হয় ইহাই নিয়ে।

(৪০)
মরি কি দুখ মনে হয় কি দুখ রে তার,-
পিচ- কারীর কলে রং টানেই নি যার;
ও যে মেলার মাঝে
একা উদাস আছে
ওযে খেলার সাজে ফেলে চক্ষের ধার।

(৪১)
যদি নেহাৎ দেবে তবে না হয় বরং-
আবীর চুলে গায়ে বাসন্তী রং!
যদি ফাগুন লাগে
তবে রঙীন ফাগে
আজি রাঙাও মোরে প্রাণে বাজাও সারং।

(৪২)
গেছে হোলীর হাওয়া চলে মাটির নীচে!
রঙের রসে সারা কানন ভিজে!
পিচ্- কারীর মত
তৃণ- কুসুম যত রভস-ভরে মরি তরঙ্গিছে!

(৪৩)
রঙে বাউল সেজে পথে এলাম ধেয়ে!
রাঙা আবীর মেখে নব ফাগুন পেয়ে!
দোলে দোলায় হিয়া
কোন্ স্বপন-প্রিয়া
আজ সবার চোখে তাই তাকাই চেয়ে!

(৪৪)
হের হোলির শেষে মোর আঙিয়া গো
শত রঙের রসে গেছে রাঙিয়া গো!
আছে ডালিম ফুলি
আছে মলিন ধূলি
আমি নিজেই নিছি সব মাঙিয়া গো।

(৪৫)
কে যে কুসুম-ফুলি রং দিল কাপড়ে!
দিল গুলাল্ কেবা মোর মনে না পড়ে!
মোর সকল বেলা
গেছে খেলেই খেলা,
হায় হিসাব যদি চাও পড়ি ফাঁপরে!

(৪৬)
ওরে আবীর যদি আজ না তোর জুটে
তবে পথের ধূলি তুলে নে দুই মুঠে!
যদি পরব লাগে
যদি হৃদয় জাগে
ধূলার ফাগে হোলি নে তুই লুটে।

(৪৭)
-সখী! কেমন হ’ল তোর হোলির মেলা?
-শুধু স্মৃতির ভরা পিচ্কারীর খেলা!
শুধু স্বপন-লেখা
হারা হাসির রেখা
একা হোলির ছলে আঁখি-সলিল ফেলা।

(৪৮)
মিছে পথের পানে চাওয়া ব্যাকুল চোখে
যে তোর আজি ডেকে নে তুই ওকে;
নেরে আপন ক’রে
ওরে নয়ন-লোরে
রঙীন ক’রে রাখ্ হৃদয়-লোকে।

(৪৯)
ওকি ধূলেই যাবে ওযে রঙের রাজা
ওকি শুধুই খেলা ওযে আধেক সাজা
মিছে কপাল ভাঙ্গা
ওযে দ্রাবক রাঙা
দারুণ দাগা ওযে আগুন তাজা

(৫০)
কত জনম যেচে কত পেলাম হাসি
মরণ সেচে আঁখি-সলিল-রাশি
কত স্বপন-গোপী
গেছে আবীর সঁপি’
কত যুগের লেহা প্রাণে জুয়ায় আসি।