মালাচন্দন

(কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে)

বাংলা দেশের হৃদ্-কমলে গন্ধ-রূপে নিলীন হ’য়ে ছিলে,
মূর্ত্তি কখন্ নিলে
কোন্ মাহেন্দ্র ক্ষণে!
ওগো কবি! তোমার আগমনে
নিখিল-হৃদয় উঠ্ল দুলে নূতন স্ফুর্ত্তি-ভরে,
কাননে ফুল ফুট্ল থরে থরে,
চাঁপার হ’ল তরিৎকান্তি,
অশোক যেন আলোয় আলো করে!
ওগো চমৎকার!
উঠ্ল ভ’রে কানায় কানায় আনন্দে সংসার!
গুমোট্ কেটে বইল দখিন হাওয়া,
পাথর-চাপা কপাল যাদের তুমি তাদের নিধি হঠাৎ-পাওয়া।
ওগো গন্ধরাজ!
একি পুলক রাজে তোমার ওই পরিমল-মণ্ডলেরি মাঝ!
স্বর্গে মর্ত্ত্যে একি আসা-যাওয়া!
তুমি এলে, বইল যেন বোধন বেলার হাওয়া!
হাজার পাখীর কৃজন গানে শেষ অবসাদ কোথায় গেল ভেসে
বিস্মরণী লতায় ঘেরা কোন্ স্বপনের দেশে!

* * *

ছয় ঋতু গায় তোমার আগে ফুল-মুকুলে পল্লবিত পালা,
স্থবির স্থাবর জগৎ জাগে উচ্চকিত চক্ষে কি তার আলা,
মৃত্তিকাময় পৃথ্বী-ছাড়া দূর গগনে কৃত্তিকা ছয় বোন
পীযুষ-ব্যথা বক্ষে নিয়ে হ’ল যে উন্মন
ধাত্রী তোমার হ’তে;
হৃদয়-রসের সকল ধারা তোমায় ঘিরে বইল উছল স্রোতে;
পান ক’রে তায়, স্নান ক’রে তায়,
দান ক’রে তায় দু’হাত ভ’রে ভ’রে
তৃষার্ত্ত প্রাণ সুধার ধারায়
দিলে সরস ক’রে।
সরস্বতীর হরষ-বীণায় স্পন্দ রূপে লুকিয়েছিলে তুমি,
কোন্ ঊষসী জাগিয়ে দিল চুমি’-
তোমায় ওগো মঞ্জুগায়ন্ কবি,
ভালে কি তার এম্নিধারা চাঁপার দিনের চাঁপার বরণ রবি?
মূর্ত্তি ধ’রে সপ্তম রাগ উদয় হ’লে রাগ-রাগিণীর মেলায়,
বাঁশীতে বশ কর্লে বিশ্ব হেলায়।
তোমার গানের পেতে সুধার কণা
এল বনের হরিণ ধেয়ে, সাপ নোয়াল ফণা!

* * *

দূর-গগনে নিকট করে তোমার গানের আলো,
ভালোবেসে যে দীপ তুমি জ্বালো
অচেনারে চিনিয়ে সে দ্যায়, পরকে আপন করে,
তোমার হিয়ার চিন্তা-মণি-ঘরে
বিশ্ব-মানব জল্সা করে, ওঠে বিপুল পুলক-ভরা গীতি,
দুখের মূল্যে আনন্দ ক্রয় চল্ছে সেথা নিতি,
ছন্দে নাচে জন্ম-মরণ পতন-অভ্যুদয়
মিলিয়ে হাতে হাত,
ছন্দ-ছাড়া নয় সেথা কেউ নয়;
মন্ত্রে পূত রাখীর সূতায় সেথা সবাই মিল্ছে সবার সাথ!

* * *

বিশ্ব-নরের জীবন-যজ্ঞে দীপ্ত ভালে তারার তিলক এঁকে
চরুর পাত্র হাতে
উঠলে তুমি কবি;-
সকল হানাহানির উর্দ্ধে থেকে
দৃষ্টি হানো নিশাচরের নৃশংস উৎপাতে
দিব্য পাবক ছবি!
তোমায় হেরে হাল্কা হ’ল চিরব্যথার জগদ্দলন শীলা,
অন্তরায়ণ-অন্তরালে বন্দীমনের শিকল হল ঢিলা!
অসুন্দরের শোধন তুমি, অসত্য আর অমঙ্গলের অরি!
তোমায় বরণ করি।
আশার গানে আলোর বানে সকল দিলে ভরি’,
প্রাণের প্রভায় স শয়েরি ঘুচালে শর্ব্বরী,
নূতন আলো দিলে, নূতন আঁখি,-
উৰ্দ্ধ-শিকড় অধঃশাখা অশথ-চারী পাখী!
মুগ্ধ হৃদয়- হারাই ভাষা- মূচ্ছি’ পড়ে মন,
বনের পুলক ফুল দিয়ে তাই মনের পুলক কর্ছি নিবেদন।
প্রণাম তোমার কর্ছি অনুপ কবি।
যার হৃদয়ের মুকুর-আগে বিশ্বপতি দ্যাখেন বিশ্ব-ছবি
নিত্য দিনই নূতনতর ছাঁদে-
চিত্তলোকে পুলক যে দ্যায়, নূতন আলোক পৌর্ণমাসী চাঁদে!