মহাসরস্বতী

বিশ্ব-মহাপদ্ম-লীনা! চিত্তময়ী! অয়ি জ্যোতিষ্মতী
মহীয়সী মহাসরস্বতী!
শক্তির বিভূতি তুমি, তুমি মহাশক্তি-সমুদ্ভবা;
সপ্ত-স্বর্গ-বিহারিণী! অন্ধকারে তুমি উষা-প্রভা।
সুর্য্যে-সুপ্ত ভর্গদেব মগ্ন সদা তোমারি স্বপনে;
সবিতৃ-সম্ভবা দেবী সাবিত্রী সে আনন্দিত মনে
বন্দে ও চরণে।
ছিন্ন-মেঘ অম্বরের নিল চন্দ্রমা
তুমি নিরুপমা।

উদ্ভাসিছে সত্যলোক নিৰ্ণিমেষ ও তব নয়ন;
তপোলোক করিছে চয়ন
নক্ষত্র-নূপুর-চ্যুত জ্যোতির্ম্ময় পদরেণু তব;
জনলোকে তোমারি সে জনম-কল্পনা নব নব
পুরাতনে নবীয়ান;- নব নব সৃষ্টির উন্মেষ!
মহীয়ান মহলোক লভি তব মানস-উদ্দেশ-
ব্যাপ্ত-পরিবেষ।
স্বর্গলোকে স্বেচ্ছা-সুখে জাগ’ তুমি গীতে
দেবতার চিতে।

ভূলোকে ভ্রমর-গর্ভ শুভ্র-নীল পদ্ম-বিভূষণা;
হংসারূঢ়া- ময়ুর-আসনা!
তুমি মহাকাব্য-ধাত্রী! মহাকবিকুলের জননী!
কখনো বাজাও বীণা, কভু দেবী! কর শঙ্খধ্বনি,-
উচ্চকিয়া উদ্দীপিয়া; চক্র-শূল ধর ধনুর্ব্বাণ;
হল-বাহী কৃষকের ধরি হল কভু গাহ গান,-
পুলকি’ পরাণ!-
সর্ব্ব-বিদ্যা-বার্ত্তা-বিধি দেখিতে দেখিতে
গড়ি’ উঠে শীতে!

মহাসঙ্গীতের রূপে গড়ি’ উঠে নিত্য অপরূপ
মানবের পূর্ণ বিশ্বরূপ,-
তোমারি প্রাসাদে দেবী! তুমি যবে হও আবির্ভাব
তখনি তত লক্ষ্য-লাভ-তখনি তো মহালক্ষ্মী লাভ।
মহাসরস্বতী দীপকের উদ্দীপনা নিয়ন্ত্রিত করি’ রুদ্র তালে
জাগো তুমি স্বতন্তরা! রক্ত-রশ্মি রুষ্ট তারা ভালে
যুগ-সন্ধ্যা-কালে।
কভু ও ললাটে শোভে শুভ্র শুকতারা
পুণ্য-পুঞ্জী-পারা।

দেবাসুর-দ্বন্দ্বে দেবী! সদ্যোজাত বজ্রের গর্জনে
তব সাড়া পেয়েছি গগনে।
সিন্ধু হতে বিন্দু ওঠে বাষ্পরূপে বিদ্যুত-সম্বল,-
বিন্দু-বিসর্গের দিনে তুমি তারে কর গো প্রবল।
তুমি কর অকুষ্টিত ভাৰ্গবের ভীষণ কুঠার;
গোত্ৰমাতা মুদ্গলানী ঋগ্বেদ বাখানে বীর্য্য যার,-
ইষ্ট তুমি তার।
সুর্য্যে রাখি’ যন্ত্র ‘পরে ছেদিল যে জ্যোতি,-
তুমি তার মতি।

পার্থে তুমি স্পর্ধা দিলে একাকী যুঝিতে মল্ল রণে
ধ্বংসরূপী মহেশের সনে।
তুমি কৌশিকের তপ, দেবী! তুমি ত্রিবিদ্যা-রূপিণী;
উষরে উর্বর কর, জন্ম-মৃত্যু-রহস্য-গুর্ব্বিণী!
অগস্ত্যের যাত্রা-পথে তুমি ছিলে বর্ত্তি নিৰ্ণিমেষ
তুমি দুর্গমের-স্পৃহা- দুরূহ, দুস্তর, দুষ্প্রবেশ
সিদ্ধির উদ্দেশ;
‘অস্তি’ নহ, ‘প্রাপ্তি’ নহ, তুমি স্বর্ণকোষ-
দৈবী অসন্তোষ।

রুদ্রের-দুহিতা দেবী! কর মোর চিত্তে অধিষ্ঠান,
সর্ব্ব কুণ্ঠা হোক্ অবসান।
বিদ্যুতেরে দূতী করি’ দ্বিধা ভিন্ন করিয়া দ্যুলোক
এস দ্রুত কবি-চিত্তে; দিকে দিকে নির্ঘোষিত হোক্
তবে আগমন-বার্ত্তা; কণ্ঠে মোর দাও মহাগান;
হে জয়ন্তী! গাহ ‘জয়’- বৈজয়ন্তী উড়াও নিশান
উদ্ভাসি’ বিমান।
সৰ্ব্ব চেষ্টা সর্ব্ব ইচ্ছা গাঁথ ঐক্য-সুরে
সুপ্ত চিত্তপুরে।

দুর্লভের গূঢ়-তৃষা দীপ্ত রাখ প্রাণের জল্পনা,
অয়ি দেবী মহতী কল্পনা!
নক্ষত্র-অক্ষরে লেখ ‘ক্ষত ত্রাণ’ ‘ক্ষতি অবসান’;
বন্দী মোচনের হর্ষে তিন লোক হোক্ স্পন্দমান।
দুর্গমের দুঃখ হর’,- জগতের জড়ত্বের নাশ
কর তুমি মহাবাণী! হে বিশ্বে পূর্ণ পরকাশ
দীপ্ত তব হাস।
সিদ্ধির প্রসূতি তুমি ঋদ্ধি আরাধিতা!
হে অপরাজিতা।

লক্ষ কোটি চিত্তে প্রাণে অলক্ষিতে বিহর’ আপনি
বুলাইয়া দাও স্পর্শমণি।
সমুদ্র মূর্চ্ছনা আর হিমাদ্রি ‘অচল ঠাট’ যার
হে মহাভারতী দেবী! গাহ সেই সঙ্গীত তোমার;
এস গো সত্যের উষা! অসত্যের প্রলয়-প্রদোষ!
বীণাধ্বনি-ঘন্টাযরালে যুক্ত হোক্ মূৰ্ত্ত রুদ্র-রোষ
শখের নির্ঘোষ;
পুণ্যে কর মৃত্যুজয়ী- পাপে ছন্নমতি,
মহাসরস্বতী!

এস বিশ্ব-আরাধিতা! বিশ্বজিত যজ্ঞে মন্ত্র তুমি,-
মনঃকুণ্ড উঠিছে প্রধুমি’
এস ভব্য-অনুকূলা! হব্যদাতা আহ্বানে তোমারে
রাক্ষস-সত্রের অগ্নি বর্জিল যে হিমালয় পারে।
ভেদ-দণ্ড তুমি পাপে, পুণ্যে দেবী! তুমি দান-সাম;
রাজ-রাজেশ্বরী বাণী! চিত্তসুখ! আত্মার আরাম!
কর পূর্ণকাম।
ব্ৰহ্ম-ছায়া তুমি অয়ি গায়ত্রী শাশ্বতী!
বিশ্ব-বিম্ববতী!

(সমাপ্ত)