মল্লিকুমারী

[ইনি মথুরার রাজকন্যা; মতান্তরে মিথিলার। মহাবীর, পার্শ্বনাথ, শীতলনাথ, শাস্তিনাথ, ঋষভদেব প্রভৃতির দ্যায় ইনি একজন জৈন তীর্থঙ্কর। চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মধ্যে নারী-তীর্থঙ্কর এই একজন মাত্র। মল্লিকুমারীর আবির্ভাব কাল বুদ্ধদেবের অনেক পূর্ব্বে।]

সকল প্রাণীতে সমান দৃষ্টি,-
কারো প্রতি মোর বৈর নাহি;
অজানিতে যদি ঘটে অপরাধ
কীটেরও নিকটে ক্ষমা যে চাহি।
ছেড়েছি হরিষ-বিষাদের বিষ,
ছেড়েছি সকল উৎসুকতা,
রতি-আরতির ঘুচেছে দ্বন্দ্ব,
মোহের বন্ধ ছিন্ন-লতা।
অশোকের তলে একাকী বিরলে
করি’ তপস্যা পদ্মাসনে,
গেছে দীনভাব, ভীরুর স্বভাব,
সকল শোচনা গেছে তা’ সনে।
বিমল শ্রদ্ধা-নীরে নিরমল
চিতে অহিংসা নিয়েছি ব্রত,
সায় হ’য়ে আসে কলুষ-কষায়
নিশি-শেষে দুঃস্বপ্ন মত।
শুক্ল-ধ্যানের সাগর-বেলায়
আছি দাঁড়াইয়া শান্ত-আঁখি,
তবু মনে হয়- এখনো সময়
হয় নি, কি যেন রয়েছে বাকী।

হে অশোক! মোর তপের সাক্ষী,
তুমি জানো মোর সকল কথা,
স্তব্ধ বৃক্ষ! তোমার তলায়
সিদ্ধ-শিলার পাই বারতা।
নিদাঘে দহিয়া, বাদল সহিয়া
জীর্ণ করেছি দেহের দ্রোহ,
গুণ-স্থানের দ্বাদশ সোপানে;
তবু নয় উপশান্ত মোহ!
তবু সংশয়, তবু মনে হয়
মৈত্রী এ মোর সর্ব্বভূতে
এ শুধু নারার মাতৃ-হিয়ার
মমতা,- দূরে না যায় কিছুতে।
বর্জ্জন যারে করেছি কঠোরে,
সে এসেছে চুপে ছদ্মবেশে,-
স্নেহ ঘন মোহ-বন্ধন-জালে
জড়ায়ে আমায় বাঁধিতে শেষে!
অগাধের মীন, পথের পিপীলি’
হ’য়ে ওঠে ক্রমে পুত্রসম;
অশোক! অশোক! ফুটাও আলোক,
ভাবনার গ্লানি নাশো এ মম।
খেলাঘরে ছিল পুতুল যাহারা
সব স্নেহ মোর দখল ক’রে
মিনতি করিল মা হ’তে তাহারা
একদা নিশীথে স্বপ্নঘোরে।
মূরতি ধরিয়া আমারে সাধিল
আমার হিয়ার মাতৃস্নেহ;
আমি কহিলাম, “বাছারে অ-নাম!
তোদের যোগ্য নাই যে গেহ।
কঠিন এ ধর কঙ্কর-ভরা,
নবনীর চেয়ে কোমল তোরা,
ঘুমাইয়া থাক্ এ হৃদি-কমলে
পরিমল-ঘন স্বপন-ডোরা।
ফিরাইয়া চোখ ফুলাইয়া ঠোঁট
মিলাইয়া গেল মূর্ত্তমায়া,
মমতার ক্ষীর-সায়রের জলে
লীলা-কুতূহলী লুকাল কায়া।
কেঁপে গেল বুক, মমতার ভুখ্
স্বপনের পাওয়া হারিয়ে ফেলে
হাহাকারে যেন জাগাল আমায়
আঁখিজলে আঁখি-কবাট ঠেলে।
স্বপ্ন-শিশুর স্নেহে অজানিতে
নেমেছিল যেই পীযুষ-ধারা,
অজানিতে গেল ফিরে সে আবার,
সারা দেহ-মনে হ’ল সে হারা!
না পেয়ে আধার অমৃতের ধার
শিরে উপশিরে মিলাল চুপে,
আজ মনে হয় হ’ল সে উদয়
হৃদয়ে বিশ্ব-মৈত্রী-রূপে।
ঘুম পাড়াইয়া যারে ঘুমন্তে
রেখেছিনু হৃদি-পদ্মপুটে,
মনে হয় সেই জলে মহীতলে
শত রূপে তাজ উঠেছে ফুটে।

তৃণে অঙ্কুর সেই তৃষাতুর-
থাকে পথ চেয়ে, মনেতে মানি,
নিত্য তাদের তৃষ্ণ মিটাই
কলসে কলসে সলিল আনি’।
পাখী হ’য়ে আসে করিয়া কাকলি
যেন জানেনাক’ আমায় বিনে;
পিপীলিকা হ’য়ে ফেরে পায় পায়,
চিনি দিব আমি রেখেছে চিনে।
মীন হ’য়ে চায় অনিমেষ-আঁখি
আমারি হাতের অন্ন লাগি’,
অতলের ডেরা ছেড়ে আসে এরা
যেন রে আমারি মমতা মাগি’।
মনে হয় এই চির-কুমারীর
মানস-পুত্র ইহারা সবে,
বিশ্বের প্রাণ করে আহ্বান
মোরে নিশিদিন, নীরব রবে।
মুখ চেয়ে থাকে, মা বলিয়া ডাকে,
ভুলে ভুলে যাই আমি কুমারী।
এ-কি অনুরাগ-বন্ধন? হায়!
এ কি অপরূপ বুঝিতে নারি।
অঞ্জলি যার অন্নের থালি,
তরুতল যার হয়েছে গেহ,
এ কি মাতৃতা-তৃষ্ণা তাহার
এ কি ব্রতঘাতী ছদ্ম স্নেহ!
অশোক! অশোক! খুলে দাও চোখ,
তুমি যে আমার তপের তরু,
তোমার ছায়ায় পাব আমি পাব
কেবলী-জ্ঞানের পরম চরু।

* * *

এ কি দেখি ছবি! সাক্ষী-বিটপী
অকালে ফুটায় কুসুমপাঁতি,-
কি বলিতে চায়?- কলুষ-কষায়
লাগেনি?- মলিন হয়নি ভাতি?
তাই এ পুলক? ফুলের স্তবক
অকালে অশোক তাই ফুটালে?
দীর্ঘ-বেলার দুখ অবসান,
তপী তরু মোর ভ্রম ছুটালে।
মিছে সংশয়,- বন্ধন নয়,
নিখিল জীবেতে এই মমতা,
নিখিল জিনের প্রসাদ ঘোষিছে
পুষ্প-তরুর প্রসন্নতা।
মিছে এ দ্বন্দ্ব কপট-বন্ধ
রচে নাই বাধা হৃদয়ে ঢুকে,
ফলের কামনা নাই এক কণা,
নিদান-শল্য নাই এ বুকে।
সকল প্রাণীর হিতে এ শরীর
ব্রতধীর হ’য়ে নিয়োজে যেবা,
তার মমতায় নাইক কষায়,
মমতা তাহীর মহতী সেবা।
জয়! জয়! জয়! নাই সংশয়,
টুটেছে সকল ভুল টুটেছে,
আমার তপের সাক্ষী-পাদপে
অকালে প্রসাদ-ফুল ফুটেছে?
জ্ঞান-আবরণ হ’ল রে মোচন,
মোহনীয় কিছু নাইক প্রাণে,
শুক্ল-ধেয়ানে সাঁতারিয়া চলি
অযোগ-কেবলী গুণস্থানে।
দেহ-কর্পূর যায় কোন্ দূর,
মনে অনন্ত-বলের লীলা,
জ্ঞান অনন্ত, আফুরান্ সুখ,
নাগালে আমার সিদ্ধশিলা।
মমতার পথে মোক্ষ আমার,
সাধনা আমার ত্রিকাল ভরি’,
বিত্ত আমার চির-চারিত্র,
হৃদয়ে ললাটে রত্ন ধরি।
প্রসূতি না হ’য়ে শত সন্তান
পেয়েছি, হৃদয়ে নিয়েছি টানি’;
প্রসবের ব্যথা যে খুসী সে নিক
পালনের ব্যথা আমারি জানি।
যুগলিক-যুগে হয়নি জনম,
যুগল-সাধনা আমার নহে,
সেই সাধনার সার যে মমতা
মনে ভায়, মোর রক্তে বহে।
নিখিল প্রাণীর পাপ্ড়ি মিলায়ে
মমতার কোলে দিয়েছি মম,
নিখিল প্রাণের চন্দ্রমল্লী
এ হৃদয়ে ভায় চন্দ্র সম!