মৃত্যু-স্বয়ম্বর

নূতন বিধান বঙ্গভূমে নূতন ধারা চল্ল রে,
মৃত্যু-স্বয়ম্বরের আগুন জ্বল্ল দেশে জ্বল্ল রে।
কুশণ্ডিকার নয় এ শিখা, এ যে ভীষণ ভয়ঙ্কর,
বঙ্গ-গেহের কুমারীদের দুঃখহারী রুদ্র বর।
মানুষ যখন হয় অমানুষ, আগুন তখন শরণ ঠাঁই,
মৃত্যু তখন মিত্র পরম, তাহার বাড়া বন্ধু নাই।
মানুষ যখন দারুণ কঠোর আগুন তখন শীতল হয়,
ব্যথায় অরুণ তরুণ হিয়া মৃত্যু মাগে শান্তিময়।
এক্টি মেয়ে চলে গেছে জগৎ হ’তে নৈরাশে,
একটি মুকুল শুকিয়ে গেছে সমাজ-সাপের নিশ্বাসে।
আগুনে সে প্রাণ সঁপেছে অগ্নিতেজা নিষ্কলুষ,
মরেছে সে; বেঁচে আছে পুরুষজাতির অপৌরুষ।
অগ্নি তুমি পাবক শুচি, আজকে তুমি রত্নধা,
পরম পুণ্যে লাভ করেছ নারীকুলের এই স্বধা।

* * * *

চলে গেছে মায়ার পুতুল শূন্য ক’রে মায়ের কোল,
চলে গেছে স্তব্ধ করে পণ্য-পণের গণ্ডগোল।
বাপের ভিটা রইল বজায়, হ’ল না সে বেচতে আর,
দায় আপনি বিদায় হ’ল জীবন-লীলা সাঙ্গ তার।
জানি কোন্ স্বর্ণ-হাঙর শূন্য হওয়ার গ্রাস গিলেছে,
(আজ) লুপ্ত-লজ্জা লোলুপতার ভাগ্যে ক্ষোভের ক্ষার মিলেছে।

* * * *

মুলুক জুড়ে প্রেতের নৃত্য, অর্থ-পিশাচ হৃদয়হীন
কর্ছে পেষণ, কর্ছে পীড়ন, করছে শোষণ রাত্রিদিন।
পুত্ৰবন্ত বেহাই ঠাকুর বেহাই-জায়া বেহায়া,
বামন অবতারের মত বার করেছে তে-পায়া।
ধার করেছেন পুত্ৰবন্ত, উদ্ধারিবে মেয়ের বাপ,
অকর্মণ্য অহল্যাদের নইলে মোচন হয় কি শাপ!
এদের নিশাস লাগলে গায়ে বুকের রক্ত যায় থামি;
চোখ রাঙিয়ে ভিক্ষা করে সামাজ-মান্য গুণ্ডামি।
স্নেহ যাদের দেহের ধাতু, মমতা যার প্রাণের কথা,
সঙ্কোচে সেই নারী মরে চক্ষে হেরে নির্ম্মমতা।
মনে মনে যাচ্ছে মরে কসাই-হাটের কাণ্ড দেখে,
শশুর খোঁজেন বাপের মান্য বাপের গলায় চরণ রেখে।
ক্ষীণ যে পুরুষ সেই অমানুষ হৃদয় তাহার নিষ্করুণ,
উদারতার ধার ধারে না, বীৰ্যবিহীন সে নির্গুণ।
অক্ষমে কি জান্বে ক্ষমা? চির-কৃপার পাত্র সে,
প্রত্যাশী সে,- পরগাছা সে,- বৃহৎ উকুন মাত্র সে।
কন্যা ঘরের আবর্জ্জনা!- পয়সা দিয়ে ফেল্তে হয়,
“পালনীয়া শিক্ষণীয়”- রক্ষণীয়া মোটেই নয়!
ভদ্র ধাঙড় আছেন দেশে করেন যারা সদগতি,
কামড় তাদের অর্ধরাজ্য,পরের ধনে লাখ-পতি।
হায় অভাগ্য! বাংলাদেশের সমাজ-বিধির তুল্য নাই,
কুলটাদের মূল্য আছে, কুলবালার মূল্য নাই।
বিয়ে ক’রে কিন্বে মাথা,- তাতেও হবে ঘুষ দিতে,
জামাই যেন জড় পদার্থ,- শ্বশুরকে চাই ‘পূশ্’ দিতে।
খুদ খেয়ে সব আছে শুয়ে দাঁতের ফাঁকে খুদ সাঁধিয়ে,
আসবে শ্বশুর সোনাপাখী, সোনায় দেবে দাত বাঁধিয়ে।
চাই শ্বশুরের সোনার কাঠি সুপ্তভাগ্য চিয়াতে,
চাই মানুষের বুকের রুধির জোঁকের ছানা জীয়াতে।

কিশোর যারা প্রাণের টানে চাইবে তারা কিশোরী,
হায় কি পাপে রয়েছে দেশ বিধির বিধান বিসরি?
যাদের লাগি ধনুর্ভঙ্গ, যাদের লাগি লক্ষ্যভেদ,-
যাদের লাগি সকল চেষ্টা, সকল যুদ্ধ সকল জেদ,-
পৌরুষেরই ধাত্রী যারা, উৎস এবং প্রবাহ,-
যাদের গৃহ,- যারাই গৃহ,- কর্মে যারা উৎসাহ,-
যাদের পূজায় দেবতা খুসী, যাদের ভাগ্যে ধনার্জ্জন,-
পুরুষ জাতির প্রথম পুঁজি, দুঃখ-ভোলা যাদের মন,
উচ্চে তাদের করবে বহন,- উদ্বাহ নাম সফল যায়,
নৈলে কিসের পুরুষ মানুষ? ক্লৈব্য পরের প্রত্যাশায়।

* * * *

সত্যিকারের পুরুষ যারা ফির্ত না’ক ভিখ মাগি,
শিবের ধনুক ভাঙত তারা কিশোরীদের প্রেম লাগি।
যৌবনও সে সত্য ছিল,- প্রতিষ্ঠিত পৌরুষে,
ছিল না’ক লোলুপ দৃষ্টি শ্বশুর-বাড়ীর মৌরুশে।
যেদিন দময়ন্তী করেন স্বয়ম্বরে মাল্যদান,
তখন নারীর দেবতা হতে নরের প্রতি অধিক টান;
আমরা এখন দিচ্ছি ভেঙে নারীর প্রাণের সেই মোহ,
পুরুষ নারীর মাঝে এখন কুবেররূপী কুগ্রহ।

* * * *

বাংলাদেশের আশার জিনিষ! ওগো তরুণসম্প্রদায়!
জগৎ আজি তোমা-সবার উজল মুখের পানে চায়;
হাতে তোমার রাখীর সূতা, কণ্ঠে তোমার নূতন গান,
জগৎ জুড়ে নাম বেজেছে, রাখ গো সেই নামের মান;
অপৌরুষের শেষ-রেখাটি নিজের হাতে মুছতে হবে,
কন্যা-বলির এই কলঙ্ক লুপ্ত কর তোমরা সবে।
সকল প্রজার প্রজাপতি পরিণয়ে প্রসন্ন,
তার আসনে কদাচারী কুবের কেন নিষণ্ণ?
তোমরা তরুণ! হৃদয় করুণ, তোমরা বারেক মিলাও হাত,
জাতির জীবন গঠন কর, কর নূতন অঙ্কপাত।
নূতন আশা, নূতন বয়স, সবল দেহ, সতেজ মন,
তোমরা কর শুভকাজে অশুভ পণ বিসর্জ্জন।
পাটোয়ারী-গোছ বুদ্ধি যাদের দাও উঠিয়ে তাদের পাট,
পাটে বস তোমরা রাজা, দাও ভেঙে দাও বাঁদির হাট।
তোমাদেরি দোহাই দিয়ে নিঃস্ব জনে দিচ্ছে চাপ,
পিতার সত্য পালন-পুণ্য, পিতার মিথ্যা পোষণ-পাপ
সতীদাহ গেছে উঠে, কন্যাদাহ থাক্বে কি?
রোগের ঋণের শেষ রাখ না, কলঙ্কের শেষ রাখবে কি?
স্বর্গে গেছে স্নেহদেবী বঙ্গভূমির নন্দিনী,
রাজপুতানার কিষণ-কুঁয়ার আজকে তাহার সঙ্গিনী;
অম্বা তাহার চুম্বে ললাট,উপেক্ষিতা সেই নারী,
যুদীয়া-গ্রীস-রোম-কুমারী স্বর্গপথে দেয় সারি।
বাপের ব্যথার ব্যথী মেয়ে কোমল স্নেহের লতিকার
ফুরিয়ে গেছে মর্তজীবন, নাইক তাহার প্রতিকার;
নারীর মান্য করতে বজায় গেছে মরণ পায়ে দলি
দেশের দশের অপরাধের নিরপরাধ এই বলি।

* * * *

স্বর্গে গেছে স্নেহদেবী, মৃত্যু তাহার বিফল নয়,
আত্মদানের সার্থকতা ওতঃপ্রোত বিশ্বময়!
মৃত্যু দানে নূতন জীবন মৃত্যুজয়ী নারী নরে,
জটু-পাকানো সংস্কারের নাগপাশে সে ছিন্ন করে।
হায় বালিকা! তোমার কথা জাগবে দেশে অন্তরে,
তোমার স্মৃতি লজ্জা দেবে পরপীড়ক বর্ব্বরে।
দেশাচারের জাঁতার তলে জীবন দেছ কল্যাণী!
টল্ল এবার বিধির আসন তোর মরণে রোষ মানি।
দশের মুখে ধৰ্ম আজি তাইত জেগে উঠল রে!
টন্ক নড়ে উঠল জাতির, পাপের প্রভাব টুট্ল রে!
স্বর্গে গেছ পুণ্য-শ্লোকা! মৃত্যু তোমার অভিজ্ঞান,
মৃত্যু-স্বয়ম্বরের স্মৃতি দহুক দেশের অকল্যাণ।