রাজপূজা

রাজার নির্দেশে শিল্পী রচিছে দেউল কাঞ্চীপুরে,
পরশে তাহার শিলা পায় প্রাণ কাঞ্চন-প্রায় স্ফুরে!
মঞ্চের পরে বসি’ তন্ময় মূৰ্ত্তি-মেখলা গড়ে,
তার প্রতিভায় পৃথিবীর গায় স্বর্গের ছায়া পড়ে!
ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, ঈশান রূপ ধরে ধ্যানে তার-
প্রাণের নিভূত ভরি’ তারি যত দেবতার অবতার।
পুষ্পিয়া ওঠে কঠিন পাষাণ পরশ তাহার লভি’,
শিল্পীর রাজা গুণী গুণরাজ স্ফটিক-শিলার কবি।
অমৃতকুণ্ডে ডুবায়ে সে বুঝি ছেদনী-হাতুড়ি ধরে
আরাপের রূপ দেয় অনায়াসে অলখ-দেবের বরে।
তার নিৰ্ম্মাণ সৃজন-সমান, বিস্ময় লাগে ভারি,
চমৎকারের মহলের চাবি জিম্মায় আছে তারি।
শিলার স্বর্গে বসি’ মশ্গুল্ যশের মালা সে গাঁথে,
শিষ্য একাকী পিছনে দাঁড়ায়ে পান-বাটা লয়ে হাতে।
আর কারো নাই প্রবেশাধিকার তার সে কৰ্ম্মশালে,
স্তম্ভারণ্যে তপোবন রচি’ প্রাণের আরতি ঢালে।
ছেনী দিয়ে কাটে, সারাবেল খাটে, স্বপ্নাবিষ্ট জাগি’,
মাঝে মাঝে হাত বাড়াইয়া পিছে তাম্বুল লয় মাগি’-
ফিরে তাকাবার অবসর নাই; দীর্ঘ দিবস ধরি’
আদ্রীর গায়ে আদর মাখায়ে রচে স্বর্গের পরী!
সহসা কি করি’ হাতের হাতুড়ি ঠিকরি পড়িল নীচে,
দোস্রা হাতুড়ি নিতে তাড়াতাড়ি শিল্পী চাহিল পিছে।
পিছে চেয়ে গুণী ওঠে চমকিয় বিস্ময়ে আঁখি থির-
তারি ডিবা হাতে কাঞ্চী-নরেশ দাঁড়ায়ে মুকুট-শির!
“একি! মহারাজ!” কয় গুণরাজ, “অপরাধ হয় মোর,
দিন্ মোরে দিন্.. প্রভূরে কি সাজে? রাজা কন্ “দিন-ভোর
এমনি দাড়ায়ে আছি ডিবা হাতে, জোগায়েছি তাম্বুল,
দেখিতে তোমার সৃজন-কৰ্ম্ম, পাথরে ফোটানো ফুল,
তন্ময় তুমি পাও নাই টের, কখন এসেছি আমি,
মোর ইঙ্গিতে কখন যে তব শিষ্য গিয়েছে নামি’,
কাজের ব্যাঘাত পাছে ঘটে ভেবে ডিবাটি লইয়া চাহি’
শিষ্যকৃত্য করেছি গুণীর হ’য়ে করঙ্ক-বাহী।”
রাজার বচন শুনি’ লজ্জায় গুণী, কহে জানু পাতি’
“মার্জ্জনা কর দাসেরে, হে প্রভু, কাজের নেশায় মাতি’
অজানিতে আজ ঘটায়েছে দাস রাজার অমর্য্যাদা,
সাজা দিন্ মোরে।” রাজা কন্, “গুণী, তব গুণে আমি বাঁধা,
ওঠ গুণরাজ! আমি পাই লাজ, তোমারে কি দিব সাজা,
বিধির সৃজন-বিভূতি-ভূষিত তুমি সে প্রকৃত রাজা।
মরণ-হরণ কীৰ্ত্তি তোমার, মোর সে ক্ষণস্থায়ী,
আমি প্রভু শুধু নিজের রাজ্যে, বাহিরে প্রভূত নাহি।
রাজপূজা তব ভুবন জড়িয়া, প্রভাব দুর্নিবার,
রাজাধিরাজেরও ভক্তি-আর্ঘ্যে, গুণী, তব অধিকার।”