(কলিকাতার সাহিত্য-সম্মিলন উপলক্ষে)
স্বাগত বঙ্গ-মনীষী-সঙ্ঘ ভূষিত অশেষ মানের হারে!
এ মহানগরে এস- আজি এস ভাবের জ্ঞানের সন্তাগারে।
এস প্রতিভার রাজটীকা ভালে, এস ওগো এস সগৌরবে,
এস পুস্তক-পুণ্ড্র পূজারী সারদার উপাসকেরা সবে।
ফুল্ল মনের অম্লান ফুল ঝরে তোমাদের সমুখে পিছে,
প্রীতির আরতি দিকে দিকে দিকে, উলু উলু উলু উল্লসিছে।
জলধি-গভীর জাতীয় জীবন,- তার প্রতিনিধি শঙ্খ ঘোষে,
অমৃতের ধারা সঞ্চরে মুহু নাড়ীতে দেশের হৃদয়-কোষে।
এস নিতি নব-নব-উন্মেষ-শালিনী বুদ্ধি করিয়া সাথী,
নূতন নগরী এই কলিকাতা আন হেথা নবীনতার ভাতি।
গৌড় আজিকে গৌরব-হারা, যশোহরে নাই যশের আলো।
অল্প বয়সী এই কলিকাতা প্রবীণেরা এরে বাসে না ভালো;
বিদেশী ইহারে করেছে লালন, স্বদেশের যত তরুণ হিয়া।
ইহারে ঘিরিয়া গুঞ্জরে তবু এরি নয়নের কিরণ পিয়া।
এনেছে তরুণী চন্দন মালা, দাড়ায়েছে আঁখি করিয়া নীচে,
নব বঙ্গের নবীনা নগরী তোমাদের সবে আহ্বানিছে।
* * * *
এই কলিকাতা- কালিকা-ক্ষেত্র, কাহিনী ইহার সবার শ্রুত,
বিষ্ণু-চক্র ঘুরেছে হেথায় মহেশের পদধূলে এ পূত।
ধাত্রী ইহার ভাগীরথী-ধারা, সতী-পঞ্জর বুকে এ বহে,
পুরাণ-স্মৃতির জড়োয়া-জড়িত এ ঠাই কখনো হেলার নহে।
হেথা প্রকাশিল অনূরু অরুণ অকালে মাতার চঞ্চুঘাতে,
আলোকের রথে সারথি যে আজ অস্ফুট-আঁখি ধূসর প্রাতে।
মহাভারতের কল্পনা-পূত মহাজীবনের কেন্দ্র ইহা,
মন্তরে এর মুঞ্জরে মন, অন্তরে এর আলোর স্পৃহা।
হিনুর কালী আছেন হেথায়, মুসলমানের মৌলা আলি,
চারি কোণে সাধু পীর চারিজন মুস্কিলাসান চেরাগ জ্বালি’।
অভিষেক হয়ে গেছে এ পুরীর স্বর্গ-নদীর হেমাম্বুন্তে,-
প্রসাদ-পরমহংস-কেশব-কালীচরণের প্রেমাশ্রুতে!
জন্মিল হেথা বিবেকানন্দ দেশ-আত্মার কুণ্ঠা হরি;
এ পুরীর রাজপথের ধুলিরে মোরা কহি রাজরাজেশ্বরী।
সকল ধৰ্ম্ম মিলেছে হেথায় সমন্বয়ের মন্দ্র-সুরে,
স্বাগত সাধক-ভক্তবৃন্দ মরতের বৈকুণ্ঠপুরে।
এই কলিকাতা ব্যাঘ্র-বাহিনী ছিল এ একদা বাঘের বাসা,
বাঘের মতন মানুষ যাহারা তাহাদেরি ছিল যাওয়া ও আসা,
প্রতাপের সেনা পৌরুষ-ভরে গিয়াছে ইহার বক্ষ দিয়া,
দক্ষিণে এর দক্ষিণ রায় বেড়েছে বাঘের স্তন্য পিয়া।
কালা পল্টন গোরা কোম্পানী একদা ইহারে করিল রাণী,
কালা ও গোরার স্মৃতির অঙ্কে বাঘ-ডোরা এর আঙিয়া খানি।
মৃত গৌড়ের অমর জীবন বিরাজিছে আজ ইহার দেহে,
সপ্তগ্রামের লুপ্ত বিভব গুপ্ত রয়েছে এ মহা গেহে।
নাহি কলঙ্ক-কালিমা অঙ্ক, সাত সাগরের সলিল আনি’
করেছে ক্ষালন মৈত্র ইহার অন্ধকূপের মিথ্যা গ্লানি।
জগতের সেরা দ্বাদশ নগরী, গণনা ইহার তাদেরি সাথে,
স্বাগত স্বদেশ-ভকত-বৃন্দ এরি রাখী ভোর পর গো হাতে।
* * * *
নবীন বঙ্গে এ মহা নগরী মন্ত্র জপিছে মৃত্যুজয়ে,
পূরবে পছিমে গেঁথে সে তুলিছে একটি বিপুল সমন্বয়ে;
দানে ও পুণ্যে ত্যাগে মহত্ত্বে গড়েছে গড়িছে ঋষির ছবি,
“তত্ত্ববোধের” “প্রচারে” ঢেলেছে “নবজীনে”র “সাধনা” হবি।
এই নগরীর জন-অরণ্য ওঠে নৈমিষ-বনের গীতি,
সত্যনিষ্ঠ ঋষি দেবেন্দ্র সত্যযুগের জাগায় স্মৃতি।
রামমোহনের ঐক্য মন্ত্র এ মহানগরী শুনেছে সুখে,
বিদ্যাসাগর দয়া-সাগরের ঢেউ খেলে গেছে ইহারি বুকে!
অক্ষয় হেথা ধৰ্ম্মের সোনা আগুনে পোড়ায়ে করিল খাঁটি,
জগদীশ হেথা জড়ের জগতে বুলাইয়া দিল সোনার কাঠি।
রমেশ হেথায় প্রচারিল বেদ সব বাঙালীরে শুনাল শ্রুতি;
হেথায় সিংহ ভাষায় রচিল ভারতের মণি ভারত পুঁথি।
দীপঙ্করের দীপখানি হেথা চির-উজ্জ্বল প্রাণের ব্যয়ে,
নব রসায়নে এ মহানগরী- নদীয়া যেমন নব্য ন্যায়ে।
রামগোপালের কর্ম্মভূমি এ, কৃষ্ণদাসের হৃদয়-প্রিয়,
হেথা বিতরিল প্রাণদ মন্ত্র বাগ্মী বন্দ্য বন্দনীয়।
নীল বানরের বদনবি দর্পণে হেথা উঠিল ফুটে,
চরণে দলিল বুটা সম্মান আটাশ নগর-জ্যেষ্ঠ জুটে।
হারামণি যারা খুজিয়া এনেছে তাহাদেরও এই লীলাস্থলী,
স্বাগত কর্ম্মী! বাগ্মী! মনীষী! স্বাগত সত্যসন্ধ! বলী!
ভাব-ভারতের সারনাথ এই, হেথায় কি এক শুভক্ষণে
চলিল নূতন বোধিচক্র সে নূতন বোধের উদ্বোধনে;
সমন্বয়ের অভিনব সাম ধ্বনিয়া ইহার উঠেছে প্রাণে,
খ্রীষ্টপন্থী ভারত-ভক্ত- তারে এ হিন্দু বলিয়া টানে!
আচারে হয় তো ত্রুটি আছে এর, বিচারে হয় তো রয়েছে গ্লানি,
তবু নবযুগে এ নব তীর্থ, নব সাধনার পীঠ এ জানি।
সনাতন রীতি মানে না এ সব, নূতনেরি যেন পক্ষপাতী;
ক্ষমা কোরো ওগো ক্ষমা কোরো তবু যৌবন আজ ইহার সাথী।
তরু-লতিকার সনাতন রীতি পত্র গজাননা সকাল সাঁঝে,
দৈবে রঙীন পুষ্প উপজে রাজাসনে যবে ফাগুন রাজে;
ফুল মাঝে ফল থাকে লুকাইয়া নব জীবনের বীজ সে ফলে,
মুকুলে লাগুক ব্যাকুল বাতাস, সনাতন সে তো আপনি চলে।
নিতি নব নব নব উন্মেষে নবীন জীবন করুক লীলা,
রসাল মুকুলে না লাগে যেন গো অকাল মেঘের দারুণ শিলা।
বুল্বুল্ আনো ফাগুন-বারতা পেচকের বুলি ভুলিতে চাহি,
স্বাগত ভাবুক! ভাবে সুতরুণ আশা আশাবরী রাগিণী গাহি।
* * * *
সাধনার পীঠ সাধের আসন শিল্পের নব জীবন-ধারা,
এ মহানগরী ভারত-আকাশে সাতাশ তারার নয়ন-তারা।
স্বাগত একদা যে দীপ জ্বালিল ধীমান সে দীপ আজি এ নগরী জ্বালে,
পঞ্চ প্রদীপ- অবনী-গগন-অসিত-মুকুল-নন্দলালে।
মাইকেল মধু হেথা সমাহিত, বঙ্কিম-হেম-ভস্মকণা
ধূলিতে ইহার রয়েছে মিশায়ে কত না ভাবুক রসিক জনা।
হেথা “মহীয়সী মহিলা”র কবি গাহিল মধুর মায়ের স্তুতি;
বিহারী বঙ্গসুন্দরী-ভালে সঁপিল শ্লোকের শুক্ল যুথী।
কবির “স্বপ্ন-প্রয়াণ” তুরগী, রবির প্রভাত-গীতির শ্রোতা
এই কলিকা কোলাহলময়ী, এর ভাগ্যের তুলনা কোথা!
কবি-গুঞ্জনে এ ধূলিপুঞ্জ ধরেছে কুঞ্জবনের ছিরি,
জগৎ উজল যার প্রতিভায় এ সেই রবির উদয়-গিরি।
হেথা আশুতোষ আশু নিরমিল নব নালন্দা শিক্ষা-গেহ,-
দেশের কিশোর হৃদয়গুলিতে বিথারি পক্ষীমাতার স্নেহ।
এরি উপান্তে বৈষ্ণব লালা লভিল প্রথম অমৃত-ছিটা;
প্রত্ন-প্রেমিক রাজা রাজেন্দ্র,- এইখানে তার আছিল ভিটা।
হেতা পরিষৎ অশথের চারা দিকে দিগন্তে পসারে শাখা,
টেঁকচাঁদ আর গুপ্ত কবির প্রকাশে এ ঠাঁই পুলকে মাখা।
গিরিশ হেথায় রঙ্গে মাতিল, রায় দ্বিজেন্দ্র হাসিল হাসি।
স্বাগত কাব্য-কোবিদ! হেথায় উজ্জয়িনীর বাজিছে বাঁশী।
* * * *
ভারতের শেষ-বয়সের মেয়ে এ নগরী আজ অর্ঘ্য নিয়া,
বঙ্গবাণীর সকল ভকতে বন্দনা করে ফুল্ল হিয়া,
চন্দন-রসে পুষ্প ডুবায়ে পরায় তিলক উজল ভালে,
মালা-চন্দন দ্যায় জনে জনে পীরিতি-পরশমণির থালে;
প্রসন্ন মনে লও যদি সবে সোনা হয়ে যাবে এ ক্ষুদ কুঁড়া,
দোষ ধর যদি, রোষ কর মনে, কুবেরেরও হয় গরব গুড়া।
মানস-ভোজর আছে আয়োজন যার যাহা রুচি, যার যা শ্রেয়,-
চারি ভাণ্ডারী বাটিছে মনের চৰ্ব্ব-চোষ্য-লেহ-পেয়।
তোমরা সাধক বাণী-উপাসক তোমরা মনীষী ভাবগ্রাহী,
অতিথি! দেবতা! মোরা তোমাদের প্রসন্নতার প্রসাদ চাহি।
চণ্ডীদাসের দায়াদ তোমরা, কবিকঙ্কণ-ধনাধিকারী,
ভারতচন্দ্র-সুধার চকোর, মধুচক্র সে তোমা সবারি;
রবির রশ্মি তোমাদেরি হিয়া রসে লাবণ্যে দিতেছে ভরি,
ভাব-ভুবনের প্রদীপ তোমরা তোমাদের মোরা প্রণাম করি।
ভাষায় তোমরা সঞ্চার কর প্রাণ-সঞ্চিত আশার জ্যোতি,
তোমাদের সমবেত সাধনায় জাগিছেন মহা-সরস্বতী।
ভাবের মুলুকে তোমরা মালিক, মালিক ভবিষ্যতের ভবে;
ভাব-লোকে যাহা সত্য আজিকে জীবনে তা কালি সত্য হবে
স্বাগত! স্বাগত! হে মধুব্রত! মনীষীবৃন্দ! মনের মিতা!
তোমা-সবাকার প্রতিভার দীপে আজি এ নগরী দীপান্বিতা।
স্বাগত জ্যেষ্ঠ! স্বাগত শ্রেষ্ঠ! স্বাগত প্রমুখ! সভাধিপতি!
স্বপ্ন-সারথি! সত্যের রথী তোমাদের মোরা জানাই নতি।