স্বর্গদ্বারে

(পুরী)

আমি স্বর্গ-দুয়ারে দাড়ায়েছি আজ
সম্মুখে পারাবার,-
সে যে অযুত জিহ্বা নাড়ি’ যুগপৎ
জপিতেছে অনিবার,-
“সোহহমহং সঃ” “বম্ বম্ বম্”
“ওম্” “ওম্” “ওঙ্কার!”

এ কি ধেয়ানের রঙে রঙীন্ সাগর
বিরাজিছে মহিমায়,
যেন মৃত্যু-মথন ভস্ম আহরি’
বিভূতি করেছে তায়,
মরণের নীল বরণ হরিয়া
অ-মৃত রাগিণী গায়!

আজি কল্পনা-দূতী লয়ে যায় মোরে
স্মরণ-সরণী পারে,-
যত মৃত্যুবিজয়ী সাধকের সাথে
সত্যের অভিসারে,-
পুণ্যের দীপে দীপালি যেথায়
বিধাতার সেই দ্বারে।

হেথা ধেয়ান নেমেছে জ্ঞানের নয়নে,
জ্ঞান সে ডুবেছে ধ্যানে,
হেথা ধ্যানের জ্ঞানের গঙ্গাসাগর,-
একাকার ধ্যানে জ্ঞানে,-
‘আমি-ও-তুমি’ চক্ৰতীর্থ
এ সাধন-উদ্যানে!

হেথা মীরা ও নানক বাঁধিয়াছে ডেরা,
কবীর পেতেছে থানা,
আর স্থাপিয়াছে মঠ শঙ্কর হেথা
ফিরিয়া তীর্থ নানা;
স্বর্গ-দুয়ার অবারিত, আর
বাধা নাই, নাই মানা।

হেথা সমাহিত সেই যবনের ছেলে
বৈষ্ণব হরিদাস,-
নিতি ভোর হতে সাঁঝ, সাঁঝ হ’তে ভোর
জপে যার উল্লাস,-
গোরা দিল যারে বেলা-বালুকায়
রচি অন্তিম বাস।

হায়, এরি কোনো ঠাই অমিয় নিমাই
অসীমে দিয়েছে কোল,-
ওই উত্তাল ঢেউয়ে হেরি শ্যামবাহু
আশ্লেষ-উতরোল!
স্বর্গ-দুয়ার- অর্গল-হারী
বাহু লাগি’ হিয়া লোল।

আমি স্বর্গদ্বারে খোলা দেখি আজ
স্বর্গের সব দ্বার,
ওগো হের আনন্দ বাজারে হেথায়
দেবতা দেছেন ‘বার’!
জাতি-পাঁতি-কুল মূল খোয়াল রে
প্রেমে হ’ল একাকার।

ওই নীল-বিভ্রমে আকাশের আলো
দিকে দিকে ‘দশা’ পায়,
আর ‘ভ্রমি’ যায় বায়ু, আয়ুহীন সম
মুহু মুহু মূরছায়,
ব্যাপি ক্ষিতি অপ্ অপসরা সব
সরে যায়, ফিরে চায়!

একি! অঙ্গ বিবশ- মন নিরলস-
চিদ্-ঘন-রস-পান!
করি দিবালোকে ফিঁকা আনন্দ-শিখা
ফুরিছে জ্যোতিষ্মান্!
মর্ত্ত-ভুবনে অমৃতের সেতু
নেহারি বিদ্যমান!

তাই স্বরগের এই সিংহদুয়ারে
সিন্ধু সতত জাগে,
সে যে অসীম-বিম্ব আকাশ-দোসর
সিংহ-সোসর হাঁকে,-
অলখ্ দেবের পাঞ্চজন্য
জনে জনে জনে ডাকে।

ও রে! কারা পিয়ে আজো মদের মদিরা?
কে পিয়ে মোহের ভাঙ্?
ওই আদি-মৃদঙ্গ বোলে তরঙ্গ
‘ধিক্ তান্’ ‘ধিগেতান্’!
দেবতার দ্বারে কে দ্বিজ শূদ্র?
কিবা সোনা? কিবা রাঙ্?

এই অসীম-সাকার- স্বপনের সেতু-
মিলনের পারাবার,-
হেথা কুণ্ঠা কিসের? দ্বন্দ্ব কিসের?
এ যে স্বর্গেরি দ্বার;-
“সোহহমহং সঃ” “ওম্” “ওম্” হেথা
মিলে মিশে একাকার।