তাজ

কবর যে খুসী বলে বলুক তোমায়
আমি জানি তুমি মন্দির!
চির-নিরমল তব মূরতির ভায়
মৃত্যু নোয়ায় নিজ শির!
প্রেমের দেউল তুমি মরণ-বেলায়,
শিরোমণি তুমি ধরণীর।

তীর্থ তুমি গো তাজ নিখিল প্রেমীর,
মরমীর হিয়ার আরাম,
অশ্রু-সায়রে তুমি অমল-শরীর
কমল-কোরক অভিরাম!
তনু-সম্পূট তুমি চির-ঘরণীর,
মৃত্যু-বিজয় তব নাম!

ঘুমায় তোমাতে প্রেম-পূর্ণিমা-চাঁদ,-
এমন উজল তুমি তাই,
চাঁদের অমিয়া পেয়ে এই আহ্লাদ
কোনোখানে কিছু স্লানি নাই;
ওগো ধবলিয়া মেঘ! আলোর প্রসাদ
ঝরে ঘিরি’ তোমারে সদাই!

যমুনা প্রেমের ধারা জানি দুনিয়ায়,-
তীর তার ঘিরি চিরদিন
পিরীতির স্মৃতি যত জেগে আছে, হায়,
অতীত প্রেমের পদ-চিন্,
ব্রজে কিবা মথুরায় কিবা আগ্রায়
রাজা ও রাখাল প্রেমে লীন।

প্রেম-যমুনার জল প্রেমে সে বিধুর
কাজ্রী-কাফিতে উন্মাদ-
গোকুলে সে পিয়াইল রসে পরিপূর
পিরীতির মহুয়া অগাধ;
শাজাহাঁ-তাজের প্রাণে সপিল মধুর
দম্পতী-প্রেমের সোয়াদ!

জগতে দ্বিতীয় রুরু রাজা শাজাহান
দেবতার মত প্রেম তার,
দিয়ে দনি আপনার অর্ধেক প্রাণ
মরণ সে ঘুচাল প্রিয়ার।
মরণের মাঝে পেল সুধা-সন্ধান,
মৃত প্রিয়া স্মরণে সাকার!

কী প্রেম তোমার ছিল- চির-নিরলস,
কী মমতা হে মোগল-রাজ!
পালিলে শোকের রোজা কত না বরষ-
ফল ভখি’ পরি’ দীন সাজ!
কৃচ্ছ্রের শেষে বিধি পূরাল মানস-
উদিল ইদের চাঁদ- তাজ।

ভেবেছিলে শোকাহত! হারায়ে প্রিয়ায়
ভেবেছিলে সব হ’ল ধূল্;
হে প্রেমী! বেঁধেছে বিধি একটি তোড়ায়
চামেলি ও আফিমের ফুল;
ঝরেছে আফিম-ফুল মরণের ঘায়,
বাঁচে তবু চামেলি অতুল!

টুটেছে রূপের বাসা, জেগে আছে প্রেম,
বেঁচে আছে চামেলি অমল;
মরণে পুড়েছে খাদ, আছে শুধু হেম
যাত্রীর চির-সম্বল,
কামনা-আকুতি-হীন আছে প্রেম, ক্ষেম,
অমলিন আছে আঁখিজল।

রচিয়াছ রাজা-কবি! কাহিনী প্রিয়ার,
আঁখিজল-জমানো বরফ-
সমতুল মৰ্ম্মর- কাগজ তুহার,
দুনিয়ার মাণিক হরফ;
বিরহী গেঁথেছ এ কি মিলনের হার!
কায়া ধরি’ জাগে তব তপ!

ভালোবাসা ভেঙে যাওয়া সে যে হাহাকার,-
তার চেয়ে ব্যথা নাই, হায়;
প্রেম টুটিবার আগে প্রেমের আধার
টুটে যাওয়া ভালো বসুধায়;
নিরাধার প্রেমধারা ভরি সংসার
উছলি পরশে অমরায়।

সে প্রেম অমর করে ধরার ধূলায়,
সে প্রেমের রূপ অপরূপ,
সে প্রেম দেউল রচি’ আকাশ-গুহায়
জ্বালে তায় চির-পূজা-ধূপ;
সম্রাট! সেই প্রেম প্রাণে তব ভায়
মরলোকে অমৃত স-রূপ।

সে প্রেমের ভাগ পেয়ে শিলামৰ্ম্মর
মৰ্ম্মের ভাষা কয় আজ,
কামিনী-পাপড়ি হেন হয় প্রস্তর,
হয় শিলা ফুলময় তাজ!
চামেলি মালতি যুথীময় সুন্দর
ছত্রে বিরাজে মমতাজ!

যে ছিল প্রেয়সী, আজি দেবী সে তোমার।
তুমি তার গড়েছ দেউল,
অঞ্জলি দেছ রাজা! মণি-সম্ভার
কাঞ্চন-রতনের ফুল।
ঢেকেছ মোতির জালে দেহ-বেদী তার
অশ্রু-মুকুতা-সমতুল।

সিংহলী নীলা, রাঙা আরবী প্রবাল,
তিব্বতী ফিরোজা পাথর,
বুন্দেলী হীরা-রাশি, আরাকানী লাল,
সুলেমানী মণি থরে থর,
ইরানী গোমেদ, মরকত থাল থাল
পোখ্রাজ, বুদি, গুল্নর,

চার-কো পাহাড়-ভাঙা মসী-মৰ্ম্মর,
চীনা তুতী, অমল স্ফটিক,
যশল্মীরের শোভা মিশ্র-বদর
এনেছ ঢুঁড়িয়া সব দিক,
মধুমৎত্বিষ্, মণি দুধিয়া পাথর
দেউলে দেওয়ালী মণি-শিখ।

সাত-শো রাজার ধন মানস-মাণিক
সঁপেছ তা সবার উপর,
তাই তো তাজের ভাতি আজি অনিমিখ্,
তাই তো সে চির সুন্দর;
তাই শিস্ দিয়ে ফেরে নন্দন-পিক
গায় কানে গান মনোহর।

তাই তব প্রেয়সীর শুভ কামনায়
ওঠে যবে প্রার্থনা-গান,
মৰ্ম্মর গুম্বজ ভরি’ ধ্বনি ধায়,-
পরশে সে সপ্ত বিমান,
লুফে লুফে ব্যোমচারা মুখে মুখে তায়
দেবতায় সঁপে সেই তান।

সে ছিল বধূ ও জায়া, মাতা তনয়ের,
তবু সে যে উৰ্বশী প্রায়
চিরপ্রিয়া, চির-রাণী, নিধি হৃদয়ের,
চির-প্রেম লুটে তার পায়;
চির-আরাধনা সে যে প্রেম-নিষ্ঠের
চির-চাঁদ স্মৃতি-জ্যোৎস্নায়।

বাদশাহী উবে গেছে, ডুবেছে বিলাস,
ভালোবাসা জাগে শুধু আজ,
জেগে আছে দম্পতী-প্রেম অবিনাশ,
জেগে আছে দেহী প্রেম তাজ;
জগতের বুক ভরি উজলি’ আকাশ
প্রিয় স্মৃতি করিছে বিরাজ।

উজল টুক্রা তাজ চন্দ্রলোকের
পড়েছে গো খসে দুনিয়ায়,
এ যে মহা-মৌক্তিক দিগ্ বারণের
মহাশোক-অঙ্কুশ-ঘায়
এসেছে বাহিরি’,- নিধি সৌন্দর্যের-
প্রেমের কিরীটে শশাভা পায়।

মনো-যতনের সনে মণি-রতনের
দিল বিয়া রাজা শাজাহান,
পুণ্য-প্রতিমা পানে চাহিয়া তাজের
কেটে গেল কত দিনমান,
বিরহীর অবসান হ’ল বিরহের
যেইক্ষণে টুটিল পরাণ।

সাধক পাইল ফিরে সাধনার ধন,
প্রেমিক পাইল প্রেমিকায়,
হৃদয় হৃদয় পেল, মন পেল মন,
কবরে মিলিল কায়ে কায়;
ঘটাইল বারে বারে নিয়তি মিলন
জীবনে,- মরণে পুনরায়।
* * * *
গোলাপ ফোটে না আর,- গোলাপের বাস
হেথা তবু ঘরে নিশিদিন,
আকাশের কামধেনু ঢালে স্মিত হাস
শীৰ্ণির ক্ষীরধারা ক্ষীণ;
মৌন হাওয়ায় পড়ে চাপা নিশ্বাস
যমুনা সে শোনে তটলীন।

মরণের কালি হেথা পায় না আমল,
শশান- ভীষণ তবু নয়,
বিলাস-ভূষণে তাজ নহে টল্মল্
রাজা হেথা প্রতাপী প্রণয়;
মৃত্যুর অধিকার করিয়া দখল
জাগে প্রেম, জাগে প্রেমময়।

আজিকে দুয়ারে নাই চাদির কবাট-
মোতির কবর-পোষ আর,
তনু-বেদী ঘিরি নাই কাঞ্চ-নঠাট,
বাগিচায় নাহিক বাহার;
তবু এ অভ্রভেদী জ্যোৎস্না জমাট
রাজাসন প্রেম-দেবতার।

মখ্মল-ঝল্মল্ পড়ে না কানাৎ
শাজাদীরা আসে না কেহই,
করে না শ্রাদ্ধ-দিনে কেহ খয়রাৎ
খির্নির তরুগুলি বই;
বাদশা ঘুমান্ হেথা বেগমের সাথ;-
অবাক! চাহিয়া শুধু রই!

ঝরে গেছে মোগলের আফিমের ফুল-
মণিময় ময়ূর-আসন,
কবরে জেগেছে তার চামেলি-মুকুল
মরণের না মানি শাসন;
অমল সে ফুলে চেয়ে যত বুলবুল্
জুড়িয়াছে পুলক-ভাষণ।

জিত মরণের বুকে গাড়িয়া নিশান,
জয়ী প্রেম তোলে হের শির,
ধবল বিপুল বাহু মেলি চারিখান
ঘোষে জয় মৌন গভীর,
চির সুন্দর তাজ প্রেমে নিরমাণ
শিরোমণি মরণ-ফণীর।