নিসর্গের নুন

(রফিক আজাদকে)
আমিও সশব্দে নিসর্গের কড়া নেড়ে দেখেছিলাম
পুকুর পাড়ের ঝোপে চুপিচুপি
ডাকাত-পড়ার ভয়ে স্পন্দমান নিঃশ্বসিত জল
কুলুপ লাগালো তার নড়বড়ে নষ্ট জানালায়

কাঠবেড়ালও নই যে কর্মঠ গতিতে তরতর উঠে যাবো
যে-কোন গাছের দোতালায় কিম্বা
ডোরা-কাটা ভারী সাপের মতন প্রাকৃতিক আহার ফুরালে
আচমনহীন পালাবো গর্তের ঠাণ্ডা কামরাতে
রাত্রির আঁধারে ইন্দ্রনীল চোখ দুটো জ্বেলে কণ্ঠের গর্জনে
সুপক্ব ফলের মতো খসে পড়বে সন্ত্রস্ত বানর!

কেক-পেসট্রির মতোন সাজানো থরে থরে নয়নাভিরাম
পুষ্পগুচ্ছের কাছেও গিয়েছি ত’, স্নান রেস্তোরাঁর
বিবর্ণ কেবিনে আশ্রয়ের যে আশ্বাস এখনও
টেবিল ও চেয়ারের হিম-শূন্যতায় লেখা আছে
তেমন সাইনবোর্ডে কোন জুঁই, চামেলী অথবা
চন্দ্রমল্লিকার ঝোপে-ঝাড়ে আমি ত’ খুঁজেও পেলাম না।

পাখির ছানার মতো দ্রুত সপ্রাণ লাফিয়ে ওঠা
পলায়নপর একটি অপটু
গোলাপের কম্প গ্রীবা ধরে আমিও চিৎকার করে
বোললাম : যা দেখছো শুধু ছদ্মবেশ এ আমার
এই জামা, এই ট্রাউজার,

এই জুতো আর
ময়লা হলুদ, এই আণ্ডারওয়ার
তোমরাই চিত্তশুদ্ধি নাকি হে দয়ার্দ্র ঘাস, গোলাপ, আঁধার।

ইতিহাসের তমসায় সশঙ্কিত শামসুর রাহমান
দাঁড়িয়ে আছেন চন্দ্রাঙ্কিত মুখে
আর মুহ্যমান আল মাহমুদ চট্টগ্রামে টিলার ওপর
বুকে পুরে ঝোড়ো আবহাওয়া
বেঁচে আছে তোমারই অশেষ কৃপায়
বাঙলা দেশে তুমি নাকি কখনও কাউকে
করো নি বিমুখ?

আমাকেই দেখে তুমি
ঘোমটা তবু তুলে দিলে বধূ? তোমার খ্যামটা নাচ
কে দ্যাখে নি? আজীবন নন্দিত রবীন্দ্রনাথ থেকে
শুরু করে তিরিশ ও তিরিশোত্তরের অনেকেই,
এমনকি কোন-কোন অনুজ পর্যন্ত! আর তোমার নিবিড়
নীলাকাশ, তার নীচে ভাঁটফুলের ঘুঙুর শুনে
একদা জীবনানন্দ দাশ বসবাসযোগ্য ভেবে
আমরণ থেকেই গেলেন বাঙলা-দেশে শহরতলীর কোন
স্বপ্ন-পাওয়া ময়লা-ধোঁয়াশা-ঢাকা বৃক্ষের মতন।

ন্যুইয়র্কে নির্বাসনে যদিও অমিয় চক্রবর্তী তবুও তো’ পেয়েছেন
কবিতার উজ্জ্বল অমল ডালাপালা
আর ক্ষিপ্ত মিসিসিপি’র গাজনে যমুনার উচ্ছল ভজন,
ভলগা-গঙ্গার ধারে ধারে
হে নিসর্গ, হে প্রকৃতি, হে সুচিত্রা মিত্র
হে লঙ-প্লেয়িং রেকর্ডের গান
হে বিব্রত বুড়ো-আংলা, তুমি গীত-বিতান আমার।

ইচ্ছে ছিলো কেবল তোমার নুন খেয়ে আজীবন
গুণ গেয়ে যাবো
অথচ কদ্দিন পরে বারান্দা পেরিয়ে
দাঁড়িয়েছি ঝোপে
ধারালো বটির মতো কোপ মেরে
কেন যে, কেন যে
দ্বিখণ্ডিত করছে না
এখনও সুতীক্ষ্ণ বাঁকা
ঐ বঙ্গদেশীয় চাঁদ।