আমি হই বর্তমান

আমি হই বর্তমান, আমি হই আদিকাল। যদিও পরি না
বাঘছাল,তুকতাক ফুঁকিনা মন্তর, চাঁপা রঙ
হাওয়াই শার্টের অন্তরালে হৃদয় একান্ত ঝাঁ-ঝাঁ,
দৃষ্টি চাননিমার পর। তোমরা গকুলে আছো আর
আমিতো জলহস্তীর পাকে পড়ে অপটু সাঁতারে
গংগিমার কাছে যেতে চাই। মগজের কোষে কোষে
আউলা ঝাউলা স্মৃতি, মাঝে-মাঝে, রৌদ্রে রৌদ্রে ঝলসিত,
মাথার ওপরে
ওড়ে গিরোবাজ। ভাবি, এ বেলা গহীন গাঙে সূর্যাস্তের আগে
স্বপ্নের মন্থনে কোনো চাচ্‌রা জেগে উঠলে বলবো,
“নটী তুই পারলিনে কিছুতেই গিলতে আমাকে।”
পৌঁছে যাবো ঠিক
কিছু মুক্তো-ঝলমল শরীরে গকুলে।
গাভীন গাইয়ের
উদরের মতো মেঘ হেলে দুলে যাবে, চিকচিকে
ঘাশুয়া মাটিতে আমি মাথা রেখে অতিল ঘুমাবো।

আছে কি স্বপ্নের ঋতু এখনো কোথাও? আজ বড়ো
প্রয়োজন স্বচ্ছতম স্বপ্নকে আমার। জুগ জুগ্‌ পায়রার
বুকের কোমল তাপে লুকিয়ে রয়েছে নাকি, নাকি
কারো আঁচলের খুটে এক মুঠো জুঁই হয়ে স্তব্ধ, ম্লান রয়েছে ঘুমিয়ে?
ইচ্ছে হয় এস-ও-এস সর্বত্র পাঠাই।

তোমরা জানো না কেউ, স্বপ্নের মাটিতে নামলাম
খালি পায়ে, চাঁদশাদা প্রান্তরের আনাচে কানাচে
গোলাপী শিখার মধ্যে নেচে নেচে চাইলশ্যা হলো
বালকের চোখ,
গিচসু উঠলো ভরে রঙিন মার্বেলে।

আমাকে দেখেই ঊর্ধ্ববাহু গাছগুলি
সবুজ চীৎকারে আন্দোলিত ঘন ঘন,
দিগন্তের চিবুকের নিচে চাঁদ ডোবে
অন্ধকারে-মনে হলো, জহুরীর নিপুণ আঙুল
কালো মখমল-বাক্সে বন্ধ করে রাখে মুক্তোটিকে।
কখনো নিঃশব্দে হাঁটি অতিকায় গোলাপের গাঢ় বারান্দায়,
কখনো-বা ভাসি
সবচেয়ে প্রবীণ মসজিদের গম্বুজের অনেক ওপরে,
সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার
ছাদের ওপরে, ফ্যাক্টরীর চিম্‌নি ঘেঁষে।
দূরে
ফোঁটা
ফোঁটা
আলো
যেন
অশ্রু-
মালা আনন্দের।
ব্যাকুল গাছের
ডালপালা ক্ষিপ্র ডানা ঝাপটায় গোধূলিপ্রবণ
মগজে আমার, চেতনায় অগণন সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আসা-যাওয়া,
আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।
কানপট্রি ঘেঁষে গেল; কতিপয় সুনীল কংকাল
হঠাৎ পেরুলো দেখি সুদূরের সাঁকো।
বহুদিন থেকে
মৃত্যু পেয়ে বসেছে আমাকে।
পাওয়াটা বিচিত্র নয়, জীবনের প্রতিটি বছর কম্‌শম্‌
মৃত্যুর তুহিন গন্ধে ভরপুর। তাইতো মাংসের অন্তরালে
ব্যক্তিগত হাড় সব কখনো সবুজ হয়, কখনো-বা নীল।
ফ্যালফ্যাল দেখি চেয়ে, মৃত্যুর পাথুরে ধলা স্তন
পান করে করে
কী এক সৌন্দর্য বাড়ে ক্রমাগত নানা বিন্যাসে লোকায়তিক।

‘স্বপ্নের বাজারদর কমেছে সম্প্রতি’-বলে গেল
নব্য খিরকা-পরা বংশধর। খড়িদোর খুলে দেখি
কেউ নেই। পণ্যময় দোকানের পাট খোলা, কোথাও গাহাক্‌
নেই কোন; অন্যমনে খাউয়া বাউয়া পথে হাঁটি
গোপাট ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে, বুঝি কানাঅলায় পেয়েছে।

মন তুমি কৃষিকাজ জানো না বলেই
করুণ কাহাতে বিদ্ধ কাট্‌টি মারি উজাড় বস্তিতে, তারপর
খিস্তির মস্তিতে মাতি, কামানি ঘুরিয়ে নিতে চাই
অস্তিত্বের; ডাঁই ডাঁই জমে ওঠে রঙিন গহন ক্যালেন্ডার
সত্তার বেকুব ভিতে। বিবেক ফতুর করে ভাবি যদি আনকোরা শিশু
নতুন বিবেক নিয়ে এসে যায় আমাদের পুরোনো দঙ্গলে…
এমন মানব জমি রইলো পতিত,
অনাবাদে ফলে নাকো সোনা।
হয়তো কোথাও
চাংবাশ মৃন্ময় হলে চাত্‌রি জ্বলে, মাটির চাপ্‌পান
পায়ে পায়ে চূর্ণীকৃত; দ্যাখো আমি হই বর্তমান, হই আদিকাল।