এ্যামনেশিয়া

ইদানীং কী যে আমার হয়েছে, আমার একদিন এবং
অন্যদিনের মধ্যে নানা ফাঁক-ফোকর
তৈরি হতে থাকে। দিনের পর দিন চুপচাপ
বসে থাকি, হাতের কলম হাতেই থেকে যায়, কোনো কিছু লেখা
হয় না, ক্রমাগত দাড়ি বেড়ে যায়, চুলের যত্ন নিতে
মনেই থাকে না।

দাড়াও বলছি কী কী যে আমার ছিল,
কী কী যে লুকিয়ে রেখেছিলাম অনেক কৌতূহলী
চোখের আড়ালে। ভয় হয়, পাছে গুলিয়ে ফেলি সব।
আস্তে-সুস্থে আমাকে মনে করতে দাও।

সে কবে যেন দুপুরকে সন্ধ্যা করে বইলো
দুরন্ত ধূলিঝড়। পেরেকবিদ্ধ হাত-পা থেকে চুইয়ে চুইয়ে
পড়ছিলো রক্ত, আমি লাল আলখাল্লার ওপর
পাশার দান ফেলছিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রোমক সৈনিক।
খেলা সাঙ্গ হবার পর সেই আলখাল্লা
হাতে হাতে কোথায় যে উধাও হলো, আজ আর
মনে পড়ছে না আমার।

আমি ঢাকা পড়ে গিয়েছিলাম লতাগুল্ম
আর পাতায় পাতায়, পাখিতে পাখিতে। রঙ-বেরঙের
ছোট ছোট পশুপাখি আসতো আমার কাছে
খাবারের আশায়। কী করে যে সেই জটিল আচ্ছাদন থেকে
বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, মনে নেই।
নিঝুম বিরানায় পথপ্রদর্শক ছিল না কেউ, আমার ঢ্যাঙা
কামনাকেই মুর্শিদ ভেবে
কুড়াল দিয়ে দুর্গম কোহে বেসতুন কেটে পথ চলছিলাম একা
একটি মধুর নামের গান গাইতে গাইতে। হঠাৎ
হাতের কুড়াল কোথায় হারিয়ে গেল, কিছুতেই
মনে করতে পারছি না আর।
বহু পথ পরিক্রমার পর ক্লান্ত হয়ে
আশ্রয় নিয়েছিলাম এক সরাইখানায়। সেই
সরাইখানার যিনি মালিক, তারা অষ্টাদশী আত্মজাকে
দেখে আমার হৃদয় ডানা-ঝটপটানো
পাখি। আমার বাম চোখ কাঁপলো পাঁচবার
আর পাঁচটি অন্ধ পায়রা,
পাঁচটি অন্ধ পায়রা
পাঁচটি অন্ধ পায়রা উড়তে গিয়ে সরাইখানার
পুরোনো দেয়ালে মাথা ঠুকে এলেমেলো পড়তে থাকে
বারংবার; তারপর যা হলো তা আগাগোড়াই
কুয়াশাচ্ছন্ন, যেখানে স্মৃতির রোদ ঝলসে ওঠে না কখনো।

সত্যের উপত্যকার আশেপাশে আমি ঘুরেছি, উপোসে শীর্ণ
সন্তদের মুখমণ্ডলের আভা
আমার সীমা-সরহদে ছড়িয়ে পড়েও পড়লো না,
আমার কপালে রেখাগুলি শতকের অস্তরাগে
রঞ্জিত হলো বিয়োগান্ত মহিমায়, আমার জীবনে আততায়ীর মতো
সওয়ার হলো দুঃখ, একটি হাত আমার দিকে
প্রসারিত হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেল মধ্যপথে। শূন্যতা নিয়ে
ফেরার পথে কাঁটাতারে ঘেরা বেগানা অঞ্চলে
শুধু আমি আর খড়গাঘাত, আমি আর খড়গাঘাত।
প্রতিদিন সকালে আয়নায় যাকে দেখি, তাকেই
মুখ্যচরিত্র ভেবে একটি নাটক লিখছি নিভৃতে।
কিছু কিছু দৃশ্যের পরিকল্পনা
লতিয়ে ওঠে দ্রুত, অথচ পুরো চরিত্রলিপি কিছুতেই
তৈরি হয় না। দৃশ্য ক্রমাগত ওলট-পালট,
অনিবার্য সংলাপ আধলেখা হয়ে থাকে। যাকে
তন্বী নায়িকা করতে চাই, সে কী ভীষণ স্থূলাঙ্গিনী
হয়ে ওঠে নিমেষে। কাহিনীর খেই হারিয়ে
নিশ্চুপ বসে থাকি বিস্মৃতির ধূসর পর্দার ঘেরাটোপে।
ইদানীয় মৃতের জন্যে ফুল নিতে চেয়ে ভুলে ফুল ছাড়াই
চলে যাই গোরস্তানে, চেনা কেউ নড করলে তাকে অচেনা জ্ঞানে
নিঃসাড় থাকি। অতীতভুক কোনো প্রাণী
ক্রমাগত চেটে চেটে নিঃশেষ করছে আমার স্মৃতির মেদমজ্জা।

অথচ এমন কিছু আছে যা ভুলে যেতে পারলে আমি বাঁচতাম।
যদি আমি ভুলে যেতে পারতাম তরুণ, কান্তিমান
নুরুল আবসারের মুখ, যে-মুখ আরো অনেক মুখের সঙ্গে
মুছে গ্যাছে একাত্তরের ব্যাপক তাণ্ডবে, যদি আমি
ভুলে যেতে পারতাম অজস্র শিশু-করোটির চোখের শূন্য কোটর,
দুঃস্বপ্নের গহ্বরের মতো গণকবরের কথা
যদি আমি ভুলে থাকতে পারতাম। যে প্লেন
তোমাকে নিয়ে বিপুল উড়াল দিয়েছিল কোন মধ্যরাতে,
তার কথা আমি মনে করতে চাই না, তবু মনে পড়ে,
আমার আর তোমার হাতের মধ্যেকার
চিরায়ত ব্যবধানের কথা ভুলতে পারি না,
দরবেশের অভিশাপের মতো
দশদিক থেকে উঠে-আসা ক্রমাগত ভাঙনের শব্দ
স্মৃতির এই দুঃসহ মড়কেও ভুলতে পারি না।