আশেক লেনের বাড়ি

বাইরে ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বৃষ্টি;
এক সময় হাওয়ার বেগ এল ঝিমিয়ে, বৃষ্টির ঘুঙুরও
ক্লান্তিতে ঢিমে হয়ে বাজে, আকাশে
তারার ফুটে ওঠার কামনার স্তব্ধতা। আমার
মাথার ভেতর অনিদ্রার কুচকুচে কাক ডাকছে
অবিরত; লালন-গীতিকা নিয়ে চেয়ারে বসতেই
দূরের পথ থেকে ভেসে আসে কোনো বাউলের গলার
আওয়াজ নয়, মনে হলো এই ধ্বনি আমার খুব চেনা।
লালন-গীতিকা পড়ে রইলো টেবিলে আর
আমার চিনতে ক্ষণকাল দেরি হলো না কয়েক বছর আগে
ছেড়ে-আসা আমাদের কদিমী কালের
আশেক লেনের বাড়ির কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠস্বর আমাকে কেমন শ্যাওলা-জড়ানো
সুরে বলে, ‘তোমার বাসর রাতের আভার তাজগীতে
নববধূর মতো উদ্‌ভাসিত হয়েছিল
আমার পুরোনো হতশ্রী মুখ,
তোমার মনে পড়ে না? অনেকগুলো শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, বর্ষা
তুমি কাটিয়েছ আমার নিবিড় সান্নিধ্যে।
আমার ছায়ায় বসে ছুটে বেড়িয়েছ তেপান্তরে, দেখেছ
পদ্মপাতায় শিশির, নারকেল গাছের মাথা দোলানো।
বর্ষার দিনে জল থই থই আমার উঠানে তোমার
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাসিয়েছে কাগজের নৌকা, তোমার পিতা
ভেসে গেছেন অনন্তে আমারই এক বড় ঘরে অদৃশ্য ভেলায়।
স্কিটসৌফীনিয়া-অধিকৃত তোমার ছোট ছেলে
কত ঝাঁ ঝাঁ দাপাদাপিই করেছে আমার ঠাণ্ডা মেঝেতে;
কত দাঁড়কাক যে কী ভীষণ ঠোকরাতো ওর করোটিকে!

‘তোমার কবিতা লেখার খরাকালীন মুহূর্তগুলো
কতবার ভরিয়ে দিয়েছি সৃজনী ধারায়-
মানে, তোমরা যাকে প্রেরণা বলে থাকো,
সেরকম ভূমিকাই মাঝে-মধ্যে পালন করেছি নীরবে।
শুনছি, এখন তোমার সত্তায় খ্যাতির রৌদ্র-জ্যোৎস্না

লুটিয়ে পড়ছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল এই আমারই অঙ্গনে,
কবি হিশেবে তোমার নাকি খুব নাম ডাক
হয়েছে আজকাল। কিন্তু কই বন্ধু, হে সখা আমার, তুমি তো
আজ অব্দি আমাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখলে না। অথচ
আমার চোখের নিচে কত কবিতাই তো লিখেছ কত বিষয়ে।

‘যখন ওরা শাবল কোদাল দিয়ে উপড়ে নিচ্ছিল
আমার হৃৎপিণ্ড, আমার হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল বুলডোজারে,
তখন আমার বিপন্ন অস্তিত্ব যে আর্তনাদ করেছিল
তা, রয়ে গেল তোমার শ্রুতির অগোচরে। আমি এখন
হাইরাইজ দালান, তবু মাঝে-মাঝে
বুক ঠেলে বেরোয় পুরোনো কান্না। হা কপাল, তুমি
একবারও দেখতে এলে না আমাকে। এই পাথুরে
শহরে বাস করতে করতে তোমার হৃদয়ও কি
কংক্রীট হয়ে গ্যাছে? নইলে এতোদিন, আমার মনোবেদনা
ফুটতো অন্তত তোমার দু’চারটি পঙ্‌ক্তিতে!
লালন-গীতিকার ওপর হঠাৎ একটা মাউথ অর্গান
মেতে ওঠে বাউলনৃত্যে, আর চমকিত আমি
ডায়েরি খুলে নিশুত রাতে কবিতা লিখতে শুরু করি
আমার যৌবনের প্রত্যূষ থেকে প্রৌঢ়ত্বের ঊষাকালে
সাক্ষী, আশ্রয়দাতা এবং সখা
আশেক লেনের সেই ক্ষয়াটে, থুত্থুরে বাড়ির উদ্দেশে।