আশৈশব এক আলোকাতরতা

আশৈশব এক আলোকাতরতা লালন করছি
আমার ভেতর। পেঁপে গাছের পাতায় পাতায় ঝলমল
করে যে-আলো, ভোরবেলা
টেবিলে-উপচানো বই আর আমার কবিতার খাতায়
যে-আলো বুলোয় স্নেহার্দ্র আঙুল, অথবা
ডাগর বিকেলে আমার প্রিয়তমার চুলে যে-আলোর
নৃত্যুশোভা দেখি, তা মহান কোনো গ্রন্থের
পঙ্‌ক্তিমালার মতো আলোড়িত করে আমাকে। এবং এখন
আমি বুঝতে পারি
আলোর জন্যে কেন মৃত্যুপথযাত্রী কবির অমন ব্যাকুলতা।

সেদিন আমি আমার সেই বন্ধুর কাছে গেলাম,
একদা যার সঙ্গে কথা বললে
আমার অন্তর হয়ে যেতো রৌদ্রঝলসিত উপত্যকা। এখন তিনি
সাফল্যের শেষ ধাপে পৌঁছে দামী তামাকের গন্ধ শুষে-নেয়া
শরীর এলিয়ে দিয়েছেন বাণিজ্য লক্ষ্মীর কোলে। তাঁর
আলো-ঝলমলে ঘরে ঢুকলে চোখ ঝলসে যায় আসবাবপত্রের
জৌলুসে। যথাসময়ে এল ট্রলিভর্তি খাবার আর কফি।
বন্ধুর সিগারেট কেস
ঝিকিয়ে উঠলো জহরতের মতো আর আমি
ফিরে এলাম এক বুক অন্ধকার নিয়ে।

আমি আমার মৃত কবিবন্ধুর একটি পুরানো
কাব্যগ্রন্থ উল্টে পাল্টে দেখছিলাম, কোনো কোনো পঙ্‌ক্তিতে
বুলোচ্ছিলাম চোখ। হায়, একদা
যে পঙ্‌ক্তিমালা আলো ছড়াতো আমার
অস্তিত্বের তন্তুজালে, আর তারা এমন নিষ্প্রদীপ কেন? কেন সেই
বইয়ের একটি পাতাও তারা-জ্বলা আকাশের মতো
হয়ে উঠলো না? আমার মনে পড়লো বন্ধুর
মধুর হাসি, হাতের নড়া,
তাকানোর ভঙ্গি। একজন মানুষের এরকম
ছোটখাটো ব্যাপারইতো গাঁথা হয়ে যায় স্মৃতির
বড়শিতে। অঞ্জলিময়
একঝাঁক নিষ্প্রদীপ শব্দ নিয়ে বসে থাকলাম অন্ধকারে।
আমার অন্য এক বন্ধু আজ বন্দি
কেন্দ্রীয় কারাগারে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই দেশে
ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে
দেবার ব্রত নিয়ে তিনি রৌদ্রজলে হেঁটেছেন বাম দিকে।
বছরের পর বছর নিঃসঙ্গতা-ছাওয়া
কারা কুঠুরি ঠুকরে ঠুকরে তাঁকে ভীষণ ক্ষইয়ে দিয়েছে ক্রমাগত-
এখন তাঁর দাঁত নড়বড়, চোখের জ্যোতি
দ্রুত বিলীয়মান। অন্ধকার সেলে অষ্টপ্রহর
ধুঁকছেন তিনি স্বদেশের মতো,
অথচ তাঁর জীবন থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে
অলোকসামান্য যে-আলো
তাতেই আলোময় হয়ে উঠেছে আমার হৃদয়।