বাস্তবিক লোকটাকে

বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি ন।
সাতরঙা পালকের টুপি তার মাথায়, দু’চোখ
ভীষণ অরুণবর্ণ; তার দিকে তাকালেই মনে হয়,
ভয়ংকর কিছু ব’য়ে বেড়ায় সত্তায় সারাক্ষণ।
আগুন আহার করে আর বিষলতার নির্যাস
করে পান। করো সঙ্গে কথা সে বলে না, এক ভিড়
মানুষের মধ্যে চুপ থাকবার তরিকা কেমন
আয়ত্তে রয়েছে তার। চুলের ডগায় সুর্যোদয়,
নখাগ্রে সুর্যাস্ত নিয়ে হেঁটে যায় একা ঔদাস্যের
ছায়ায় নিঃশব্দে হেঁটে যায় গোধূলিতে নেমে পড়ে
কোথায় গোপন নিচে, করে ওজু শোকের দিঘিতে।

মধ্যরাতে শহরের মধ্যপথে অভ্রের নদীতে
ভাসায় সুনীল নৌকো, রাশি রাশি বাঁশির স্থাপত্যে
বানায় সুদীর্ঘ সাঁকো সড়কে সড়কে সব দিকে।
বাতাসের, গোধূলির, নিঃসঙ্গ শহুরে কুকুরের,
পাখির ক্রীড়ার সায় আছে তার প্রতি। পাহাড়ের
কাছাকাছি থাকে, না কি হ্রদের কিনারে অতিশয়
নিরালা নিবাস তার? তাকে দেখে দৃষ্টি পুড়ে যায়।

হৃদয়ের বহুমুখী ক্ষত তার চোখ হ’য়ে জ্বলে
সর্বক্ষণ, বেড়ে যায়। ক্ষতের পাশেই স্মৃতিময়
উপত্যকা তৈরী করে লাগায় জাগর পাছপালা।
গভীর শিকড় নিমেষেই শুয়ে নেয় ক্ষতরস!

বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।
তবু সে প্রায়শ মধ্যরাতে আমার টেবিলে ব’সে
ছিটোয় বিস্তর কালি খাতার পাতায়, কখনো বা
ঘন ঘন করে পায়চারি কালো বারান্দায় কিংবা
খুপরিতে, মাথা নাড়ে, তাকায় আমার দিকে তীক্ষ্ম
ক্ষুধিত দৃষ্টিতে, বুঝি নেবে শুষে অস্তিত্ব আমার।
আমার শিয়রে রাখে তরবারি, আমি নিরুপায়,
রুদ্ধবাক প’ড়ে থাকি, যেন ক্লান্ত, শীর্ণ পথরেখা।

যত বলি চ’লে যাও স্বচ্ছাচারী, এখানে তোমার
প্রবেশাধিকার নেই, গেরস্থালি করো না বেবাক
তছনছ, ততবার আমাকে ভীষণ ফুঁড়ে একা
ঘরে ঢুকে প’ড়ে বসে আমার টেবিলে, খুব ভোরে
সহসা প্রস্থান করে মোরগ ডাকলে পরে। রৌদ্রে
ঘর নিরিবিলি হেসে উঠলে দেখি আমার টেবিলে
পড়ে থাকে পাতালের লতাগুল্ম, মৎস্যাকুমারীর
জলজ নিশ্বাস আর সুদূর নীলিমা এক রাশ,
প্রাচীন সোনালি তন্তু হাহাকার খানিক দিব্যতা।

যখন আমার মেধা রটে মুদ্রাক্ষরে দিগ্ধিদিক,
অথবা মাইক্রোফোনে আমার প্রতিভা আমি খুব
নিমগ্ন আবৃত্তি করি, মালা আসে, বাজে করতালি,
তখন সে ভাঙা কবরের ওপর নিঃসঙ্গ ব’সে
মড়ার খুলিতে দ্রুত তবলা বাজায়, চুমো খায়
মৃত্যুর ঘাগরা-পরা বারবণিতার ওষ্ঠময়।

বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।